preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
ব্যবচ্ছেদ: পর্ব ১
ধারাবাহিক

ব্যবচ্ছেদ: পর্ব ১

বুকুদার সাথে অনেক অনেক খেলেছি। তখন আমাদের কোনো ট্রেনর ছিল না। অথচ খেলার বিরাট শখ ছিল। আর এই বুকুদাই আমাদের খেলা শেখাত, বিনা পয়সায়। সেসব দিনই আলাদা ছিল, যদিও তা ভালো কি মন্দ ছিল তা জানি না। তবে সেসব দিন যেন এক ঘোরের মতো ছিল। মনে পড়ে এই আমাদেরই ঘরে মিটিং চলছে, ছুটে ছুটে বাইরে যাচ্ছি, জল দিচ্ছি, কারোর ঘর থেকে লুচি আসছে, কারোর ঘর থেকে আলুর দম। জমিয়ে রাখছি, পরে মাঠে গিয়ে আবার সেসব খাওয়া হচ্ছে, অনেক স্মৃতি। কিন্তু এখন কি সেসব কারোর মনে রাখার মতো? দেখছি...
শুরু হল দেবনাথ সুকান্তের নতুন ধারাবাহিক ‘ব্যবচ্ছেদ’। প্রকাশিত হল প্রথম পর্ব।

এক

নিখিলের কোনো মানপত্রের প্রয়োজন ছিল না। প্রয়োজন ছিল না কোনো নেতার হাত। সে তাই রাস্তা থেকে ঘর পর্যন্ত পড়ে থাকা সব কটি ফুটপাতে নিজের চিহ্ন রেখে চলে এসেছিল। যদিও সে জানতো একদিন কেউ-না-কেউ তাকে খুঁজতে খুঁজতে এই কোম্পানি কোয়ার্টারে পৌঁছে যাবে। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর যে কোয়ার্টার কোম্পানি তার আধমরা শ্রমিকদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তখন ঠিক তক্ষুণি সে এবং তার পঙ্গু মা সারাজীবনের জমানো দর্পিত নিঃশ্বাস দেরাজ খুলে দেখাবে অকপটে। মা তাকে বলবে, বাবা এবার একটু চা কর, সে উঠে এগিয়ে যাবে ঘর ছেড়ে। মা নিজের মনে জানালার দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে। আর দেরাজে বিবর্ণ পড়ে থাকা এতদিনের শিল্ডগুলো যেন নিজেদের কবর খুঁড়ে উঠে আসবে সম্মুখে।

তাহলে কি লোকের নজর কেড়েছে সেসব শিল্ড। না তা মনে হয় না, বরং তার নীচে ধুলো মলিন মোটা মোটা লাল মলাটের বইগুলো যেন আরও সহানুভূতির দাবিদার। এই তো সেদিনও তাদের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মনের মধ্যে একটা শিহরণ জাগত। কিন্তু এখন কেন মনে হয় এরাই ঠিক, এরাই আমাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী। নিখিল মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, মা কিছুক্ষণ চোখে চোখ রাখে, যেমন সে গোটা জীবন করে এসেছে। তারপর এক অপরাধবোধে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কেননা এখন আর তিনি বকুলদি নন। এখন আর তিনি মহিলা সমিতির নেত্রী নন। এখন তার ছেলে তার দিকে তাকিয়ে যেন প্রশ্ন করছে, কী পেলে মা। মা ছেলেকে বলছে তুই ফুটবল খেলে যা পেয়েছিস। আমিও তাই পেয়েছি ব্যাস।
তাও আজকে যারা যারা এসেছে তাদের কথা?
—কি আর বলি পিসি, বুকুদা যদি একবার আসত, আমাদেরে স্কুলের একজন স্পোর্ট টিচারের দরকার ছিল খুব। কিন্তু বুকুদার কোনো হেলদোল নেই। তারপর আবার স্টুডেন্টদের বাবা মায়ের এত চাপ, এখন তো আর আগের মতো স্কুল নেই, সব বদলে গিয়েছে।

নিখিল তার ছিঁড়ে যাওয়া স্পাইকের দিব্যি মনে মনে কেটে বলে
—তাই নাকি এখন সব বদলে গিয়েছে? আর আগে কি ফুটবল ক্রিকেট গ্রাউন্ডে খেলা হত?
—আরে না না বুকুদা, তা আর বলছি না, আসলে এখন স্কুল পরিচালনায় অনেক হেরফের হয়ে গিয়েছে, এখন আমাদের মমতাময়ী পরিচালিকা নতুনের গান গান। আর তাই করতে হয়।
—সেই, কিন্তু এখন তাহলে কী মনে করে?

এই হল আসল প্রশ্ন। এখন তাহলে কী মনে করে ভাই? এখানে আমি আমার পরিচয় না দিয়ে পারি না। অনেক অনেক চেষ্টা করেছি যদি কোনোরকমভাবে নিজেকে দূরে রাখা যায়। কিন্তু হাতে আসা সরকারি চাকরি কীকরে ছেড়ে দি? অবশ্য যদি চাকরিটা না নিতাম আমিও ভালো ব্যবসা করতে পারতাম। যদিও আমি বাঙালি তবু। বাংলাকে ভালোবেসে এবং ব্যবসাকে ভালোবেসে। যাইহোক নদীর মতো জীবন হলে ভালো, নাহলে নালা হয়ে না পড়ে থাকতে হয়? বুকুদার সাথে অনেক অনেক খেলেছি। তখন আমাদের কোনো ট্রেনর ছিল না। অথচ খেলার বিরাট শখ ছিল। আর এই বুকুদাই আমাদের খেলা শেখাত, বিনা পয়সায়। সেসব দিনই আলাদা ছিল, যদিও তা ভালো কি মন্দ ছিল তা জানি না। তবে সেসব দিন যেন এক ঘোরের মতো ছিল। মনে পড়ে এই আমাদেরই ঘরে মিটিং চলছে, ছুটে ছুটে বাইরে যাচ্ছি, জল দিচ্ছি, কারোর ঘর থেকে লুচি আসছে, কারোর ঘর থেকে আলুর দম। জমিয়ে রাখছি, পরে মাঠে গিয়ে আবার সেসব খাওয়া হচ্ছে, অনেক স্মৃতি। কিন্তু এখন কি সেসব কারোর মনে রাখার মতো? দেখছি...

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

নিখিল একভাবে দেখে যাচ্ছে সামনে বসে থাকা টোটো ইউনিয়নের নেতাকে। তার বাবা বাজারে মাছ বিক্রি করত। সেটা কথা নয়। মাছের সাথে তার কোনো বৈপরীত্য নেই। বা টোটোর সাথেও নেই বৈমাত্রেয় সম্পর্ক। যদিও সে জানে মা-দের সময়ে কোনোভাবেই এটা সম্ভব ছিল না। তখন প্রতিটি ধাপ পেরোতে পেরোতে বছর বিশেক সময় লেগেই যেত। তা এখন তার ভ্রূ কুঞ্চিতই রয়েছে আর সে দেখছে, ছেলেগুলো বাস্তবিক বড়ো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে কোনোরকমভাবেই নিজেকে ছোটো মনে করে না। তবু এরা কি তাকে সাহায্য করবে বলে এসেছে?

আমি তাকিয়েই বুঝতে পেরেছি বকুল পিসি যেন এখন আমাদের দর্শকের দিক থেকে দেখছেন। যা তিনি কোনোদিন করেননি। বরাবর তাকেই সবাই দেখে এসেছে। যদিও তিনি দেখতে ভালো ছিলেন না। গায়ের রং শ্যামবর্ণ, এবং উচ্চতা পাঁচ আট কি দশ। তাহলে কি নারীর নিজেকে নিয়ে গর্ব এখানে বিপরীতমুখী। বা ঋণাত্মক অহংকার। জানি না, জানা সম্ভব নয় তাই। বকুল পিসি সেই যে বলে যেতেন আর সব মহিলারা তার দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে যেত, এখন কেমন যেন পিসি নিজেই হাঁ হওয়ার বাসনায় বিভোর। বা তিনি অন্যকিছু দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছেন। আমরা তার কাছে এসেছি এটাই এখন এক বিরাট ব্যাপার। কারণ তিনি জানেনে, অন্তত আমি জানি কীভাবে বিশ্বাস অর্জন করতে হয়।
—কিরে তোরা কি আর কিছু বলবি?
—বলব বলতে, আসলে ভাবছিলাম আমাদের ক্লাবে যদি বুকুদা আসত, তাহলে আমাদের যে নামটা দেওয়া আছে উজ্জ্বল সংঘ স্পোর্টিং ক্লাব তা সার্থক হত আর কি।
—উজ্জ্বল সংঘ সেই ক্লাবটা, সেটা এখনও বেঁচে আছে?
—আরে বুকুদা তুমি তো কোনো খবরই রাখ না, এখন আর সে ক্লাব নেই এখন সব রং-চং করে একেবারে অন্যরকম।
—সে তো বটে হবেই, নতুন রং বরং একটা খেলা, যার জন্যই ওই স্পোর্টিং নামটা রয়েছে নাকি?
—তা নয় পাশে একটা খেলার মাঠও রয়েছে।
—খেলার মত ছেলেপিলে?
—সেও বললে আমরা তুলে নিয়ে আসব।

নিখিল তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারে না। কারণ সে জানে আমি কী কথা বলে চুপ করে গেলাম। চুপ করে যাওয়া নিঃশ্বাস রয়ে গেল আমাদের মধ্যবর্তী ব্যবধানে। যা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়। পূরণ বলতে বাস্তবে কী তা জানা না থাকলেই অবশ্য ভালো। যেমন তার আলমারিতে নিশ্চুপ বসে থাকা শিল্ডগুলো। যাদের জীবনে কোনো আপত্তিকর অধ্যায় নেই। নিখিলের জীবনেও তেমন কোনো অধ্যায় সংযোজিত হয়নি। তাই সে বুঝতেই পারে না, আমি কীকরে এখন তার সামনে বসে আছি। সে মায়ের দিকে তাকায় আর একটু হেসে ফেলে।

বকুল পিসি বলতে গেলে আমিও কম নই। আমিও বুঝতে পারি, মানুষ বড়ো অসহায়, মানুষ শুধু বেইমান নয়। নিখিল যখন একটানা হসপিটালে হাঁটু ভেঙে পড়েছিল তখন আমিও তো ছিলাম অনেক অনেক বিনিদ্র রাত নিয়ে। সে-রাতের গল্প কি কম দামি আমার কাছে। বুকুদা তখনও বুকুদাই ছিল, নিখিল হয়ে যায়নি। তার পা থেকে ছুটে যাওয়া বল তখন নির্দিষ্ট গোলের দিকেই যেত, দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়ে থাকত না আলমারির ভিতর।
—তোর মা কেমন আছে রে?
—মা ভালোই আছে এখন।
—আর তোর বাবা?
—বাবাও ঠিক আছে,
—আমাদের কথা বলে কিছু?
—বাবা এখনও মাঝে মাঝে বলে পুরোনো দিনের কথা।
বকুল পিসি যা কিছু বলতে চায় তা আমার মর্ম পর্যন্ত নিজের ঘর করেছে। কেননা ঘরের দাম এখন অনেক। আর বাবা তার কিছুটা বিক্রি-বাট্টা করে ফ্ল্যাট তুলেছে সেখানে। এসব বটে অন্য কথা কিন্তু কথা যখন রয়েছে তখন তার পিছনে কারণ যে থাকবেই তা নিশ্চিত। আমি বকুল পিসির সাথে যদিও একমত তাও ঘরের মাঝে অনেক দেয়াল রয়েছে। রয়েছে দেয়ালের মাঝে অনেক ফাটল। বকুল পিসি সেসব জানে এবং জানে না। দুটোই সত্যি। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে তুমি কি ঈশ্বর বিশ্বাস কর? কী উত্তর দেব? মনে হয় আমিও জানতে চাইব, আপনি কোন সিচুয়েশনের কথা বলছেন? সময়ে না অসময়ে? তা যাইহোক এখন কি এখানে কোনো বিজ্ঞাপনী বিরতির দরকার ছিল? না কোনো গান, যা দিয়ে এই না নিতে পারা পরিবেশ কিছুটা হালকা করা যায়! ভয় করছে, বুকুদা এখানে না আবার নিখিল হয়ে যায়।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

দেবনাথ সুকান্ত একজন লৌহ ইস্পাত কারখানার শ্রমিক এবং সেই শ্রমিকের চোখ দিয়েই দেখতে চান তাঁর কাঙ্ক্ষিত পৃথিবী, যা উঠে আসে তাঁর যাপিত জীবনের কবিতা এবং গল্প উপন্যাসে। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রেরা তাঁর গহন মনের ভিতর রেখে যায় ইস্পাতের মতো দৃঢ় চেতনার সমন্বয়। তার কিছুটা তিনি লেখেন, কিছুটা জমিয়ে রাখেন কালের প্রবাহের জন্য। এর আগে লিখেছেন, ‘ছেদবিন্দু', ‘টানেলের মুখে কিছু হায়ারোগ্লিফ’, ‘এক অপরিহার্য রক্তরেখায়’, ‘অন্ধকারে এক জলস্রোত’-এর মত কাব্যগ্রন্থ, ‘রক্তাক্ত স্পর্শের আলো’-এর মত উপন্যাস। যা আসলে তার অতীতকে খুঁজে নিজেরই মুখ বার করার এক প্রয়াস। তার বেড়ে ওঠা দুর্গাপুরে। চাকরি সূত্রে ঘুরেছেন, হাজারিবাগ, বোকারো, ধানবাদ, রাঁচি আর বার্নপুর। ভালোবাসেন বই পড়তে আর বাঁশি বাজাতে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন