...ঘরে ঢুকতে যাবে সরস্বতী, পিছু ডাকে রতন।
“এই শোন এইদিকে?”
“বল...”
“কাল দুগ্ধা গিয়েছিলি শুনলাম...। অনাদি গোসাঁইয়ের সাথে দেখা করতে?”
বোন জানে, ‘দুগ্ধা’ কিম্বা ‘গোসাঁই’ এইগুলো দাদার আসল কথা নয়। সরাসরি প্রসঙ্গে সরস্বতী, “হ্যাঁ কাল আবদুলের সাথে দেখা হয়েছিল...।”
“কেন দেখা হয়েছিল?”
গলার আওয়াজ এইবার বেশ কঠিন রতন বৈগার। কিছু না বলে চুপ করে থাকে সরস্বতী। “বল গিয়েছিলি কেন...?”
আমরা এতক্ষণে জেনে গেছি যে, বিশ্বামিত্র হত্যা রহস্য উন্মোচনে যাদের ভূমিকা আছে তাদের মধ্যে সরস্বতীও আছে। এই পর্বে একবার ফিরে তাকাতে হবে তার দিকেও...
পঁয়তাল্লিশ
শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। হাওড়া।
ট্রেনটা এতক্ষণে বেশ জোরে ছুটতে শুরু করেছে। স্মৃতিচারণে মগ্ন স্বপ্ননীল।
ছাদে ওঠা ইস্তক সম্মোহিত হয়েছিলেন বিশ্বামিত্র সেন। অবলোকন করছিলেন এক অলীক স্বপ্ন। নেশার চটক ভেঙে বার হতে চাইছিলেন না। কিন্তু নীলের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। বিশ্বামিত্রকে দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে যায় সে। রত্নাকর বাবুর সামনে গিয়ে বলে, “দাদু উনি এসেছেন... তোমার সাথে দেখা করার জন্য।”
রত্নাকর বাবু ছিলেন জলঙ্গীর বাতাসে উড্ডীয়মান। পৌত্রের কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙে। নিমীলিত চোখে তাকান, “কে?”
নীল বিশ্বামিত্র বাবুকে দেখিয়ে দেয়। এগিয়ে এসে রত্নাকর বাবুকে একটা প্রণাম করেন বিশ্বামিত্র। “আপনি? আমি ঠিক...।”
“আপনি আমায় চিনতে পারবেন না রত্নাকর বাবু।”
“বাহ্ আপনি আমার নামও জানেন দেখছি।”
রত্নাকর বাবু নীলকে বলেন একটা চেয়ার এনে দেওয়ার জন্য।
আসুদা বিকেলের চা নিয়ে উঠে এসেছিল উপরে। আরাম কেদারার সামনে একটা গোল কাঠের টেবিল। চায়ের পাত্র সেখানে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে, আমি নিয়ে আসছি।
আরও একখানা আরাম কেদারা এলে বসে পড়েন বিশ্বামিত্র। রত্নাকর বলেন, “হ্যাঁ বলুন, আমার নাম আপনি জানলেন কী করে?”
“আসলে আমার কাজের সূত্র ধরেই।”
“কাজের সূত্র ধরে! কী কাজ আপনার? ব্যবসা না চাকরি?”
এইবারই যেন একটু একটু করে স্বপ্ননীল রহস্যের গন্ধ পেতে শুরু করে, “আজ্ঞে চাকরি করতাম একটা...।”
“চাকরি করতেন...! অতীতকাল! কিন্তু আপনাকে দেখে অবসরের সময় হয়েছে বলে তো মনে হয় না!”
“না ফুলটার্ম কমপ্লিট করিনি। ভি আর এস।”
“কোথায় ছিলেন ?”
“সেন্ট্রাল ফরেনসিক সাইন্স ল্যাবে। কলকাতাতেও ছিলাম কিছুদিন।”
ফরেনসিক ল্যাব...ভি আর এস...কাজের সূত্রে চিনতে পারা, সব মিলিয়ে রত্নাকর যথেষ্ট কৌতূহল বোধ করেন। মানে আপাত দৃষ্টিতে দেখলে সেটাই মনে হবে। বলেন, “সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাব এটা নিশ্চয়ই গভার্নড বাই সেন্ট্রাল গভর্মেন্ট...?”
আসুদা বিশ্বামিত্র বাবুর জন্য চা নিয়ে আসে। টেবিলে রেখে আবার নীচে নেমে যায়। নিজের পেয়ালায় একটা চুমুক মারেন রত্নাকর। কাপটা রাখতে রাখতে শেষ করেন বাক্যটা , “তা ওত ভালো চাকরি ছেড়ে দিলেন মাঝপথে? কোনও রিমোট ট্রান্সফার?”
“চাকরিটা ছাড়লাম স্বাধীন ভাবে যেটা করতে চাই সেটা করতে পারব বলে।”
বিশ্বামিত্রের রহস্য ডালপালা মেলতে শুরু করে। রত্নাকরবাবু বলেন, “বেশ..., কিন্তু তার সাথে আমার সম্পর্কটা কোথায়?” কথাটা বলে স্বপ্ননীলের দিকে একটা পূর্ণদৃষ্টি দেন রত্নাকর। যার অর্থ বড়দের কথায় না থাকাই শ্রেয়। চলে আসছিল নীল কিন্তু বিশ্বামিত্রের বাক্যে আবার ঘুরে দাঁড়ায়। “আমার মনে হয় স্বপ্ননীল এখানে থাকলে ভালোই হবে।”
নীল বলে, “আপনি আমার নামও জানেন দেখছি।”
“বা রে তুমি তো আসার সময়ই আমাকে বললে তোমার নামটা।”
কথাটা বলে একটু মুচকি হাসেন, “অবশ্য তুমি না বললেও আমি জানতাম..., তোমাদের অনেক কিছুই আমি জানি...।
নীলের ভিতর থেকে একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে আসে, “মানে!”
একটা চিনে বাদামওয়ালার চিৎকারে চটকা ভাঙে স্বপ্ননীলের। জলের বোতলটা হাতে নিয়েই বসেছিল। এইবার ব্যাগের পকেটে রাখে। সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ছুটে চলেছে ট্রেনটা। বিরামহীন।
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
ছেচল্লিশ
ফুলওয়ারিতোড়। ঝাড়খণ্ড।
আমরা জানি যে বিশ্বামিত্র হত্যা রহস্য পাক খাবে যাদের ঘিরে তার মধ্যে সরস্বতী বৈগাও আছে। কাজেই, তাদের দিকেও মাঝে মাঝে একটু নজর দিতে হবে বৈকি। তাই একঝলক ঘুরে আসা যাক ফুলওয়ারিতোড়ের বৈগাপাড়ায়। আবদুলের গাজি বটতলার পাশেই এই বৈগাপাড়া।
নিকোনো মেঝের ঠিক হাত আস্টেক উপরে মাচাটা। দরকারি অথবা বাতিল নানা জিনিসপত্র। ভাঙা মগ, বালতি, লেপকাঁথা, জামাকাপড় ইত্যাদি। ভালো করে খুঁজলে সেই ভাঙা পুতুলটাও পাওয়া যাবে, যেটা নিয়ে বহুকাল আগে খেলত সরস্বতী। ওই মাচায় একবার উঠতে হবে রতনকে। খুঁজে দেখতে হবে একটা জিনিস।
ভাবতে ভাবতেই ঘরাঞ্চিটা জায়গামত লাগিয়ে রতন উঠে পড়ে মাচায়। গোটা দুয়েক ধেড়ে ইঁদুর শব্দ করে সরে যায় এদিক ওদিক। চালের হাঁড়ির ঢাকনাটা সরিয়ে ভিতরে চালান করে দেয় হাতের পাঞ্জাখানা। এই পাত্রটা দেখাই উদ্দেশ্য ছিল তার।
রতনের বাপ পরমেশ্বর বৈগা ছিল ভাগচাষি। প্রথম জীবনে ‘জন’ খাটত মুসলমান পাড়ায়, পরে মোহান্তি ঠাকুর কানে মন্তর দেয়। মুসলমান পাড়া ছেড়ে দেয় সে। সেই থেকে দাঙ্গায় মরার আগে অব্দি, মজুরি খেটে গেছে মন্দিরের দেবোত্তর জমিতে। পারিশ্রমিক আগের থেকে প্রায় অর্ধেক। কিন্তু তাতে কী, মন্দিরের জমি বলে কথা।
ভাগ্যিস ডি ভি সি প্ল্যান্টে ঠিকাদারের কাজটা পেয়েছিল রতন। মা মরা তিনজনের সংসারটা ভেসে যেতে যেতে বেঁচে যায়। কিন্তু ছোটলোকের সুখ ভগবানের বোধহয় সহ্য হয় না। কাজেই, দাঙ্গার পর এখন আবার বেকার। সে আর তার বোন সরস্বতী, দুজনের কোনোরকম দিন গুজরানও এখন যেন বিষম দায়।
ভিতরে হাত দিয়েই মনে পড়ে, যেটুকু চাল ছিল হাঁড়িতে শেষ হয়ে গেছে কাল রাতে। সিমসিদ্ধ দিয়েই সাবড়ে দিয়েছে সবটা। খালি পাত্রে বার দুয়েক হাতের পাঞ্জাখানা ঘুরিয়ে বার করে আনে সে। ভুষি ছিল ভিতরে তাই হাতের তালুটা সাদাটে। চালের গন্ধ কয়েকবার বুক ভরে নিয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে ঘরাঞ্চি বেয়ে।
পিছন ঘুরতেই দেখতে পায় সরস্বতীকে। কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে, “কী করছিলি রে দাদা ঐখানে?”
“ও কিছু না এমনি...”
“এমনি! এমনি ঐখানে উঠে বসে ছিলিস...!”
আরও দু এক কথা বলতে যাচ্ছিল সরস্বতী। কিন্তু দু’লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় রতন। হন হন করে এগিয়ে যায় সমুখপানে। তালের বাঁখারির বেড়া চারদিকে। ফটকটা আকন্দ খুঁটির সাথে বাঁধা নারকেল দড়ি দিয়ে। এক টানে খুলে বার হতে চায়। কিন্তু বাঁধন আলগা হয়ে গিয়েছিল বোধহয়। হ্যাঁচকা টান সহ্য করতে পারে না। কড়মড় আওয়াজ করে হেলে যায় একদিকে। ছুটে আসে সরস্বতী,
“কী হল রে?”
আসলে সরস্বতীর থেকে ছুটে পালাচ্ছিল রতন। হয়ত বা নিজের থেকেও। বলে, “ও কিছু না। গেড়োগুলো আলগা হয়ে গিয়েছিল মনে হয়...।”
“ও আচ্ছা। এই নে...।”
গোটা দুয়েক নকুলদানা আর একটা বাতাসা। মন্দিরের প্রসাদ। এগিয়ে দেয় সরস্বতী।
“আমি খাব না। তুই খা।”
“খিদে পায় নি তোর?”
“না।”
কাজকম্মো নেই রতনের। খিদের জ্বালায় যখন পেট মোচড়ায়, তখন ভাবে এবার না হয় ওই মন্দিরেই কিছু একটা করবে, কিন্তু সরস্বতী যখন প্রসাদ দিতে চায় তখন সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। নাহ , ওই রকম ছুঁড়ে দেওয়া ‘রুটির টুকরো’ আজও নিতে পারে না সে।
ঘরে ঢুকতে যাবে সরস্বতী, পিছু ডাকে রতন।
“এই শোন এইদিকে?”
“বল...”
“কাল দুগ্ধা গিয়েছিলি শুনলাম...। অনাদি গোসাঁইয়ের সাথে দেখা করতে?”
বোন জানে, ‘দুগ্ধা’ কিম্বা ‘গোসাঁই’ এইগুলো দাদার আসল কথা নয়। সরাসরি প্রসঙ্গে সরস্বতী, “হ্যাঁ কাল আবদুলের সাথে দেখা হয়েছিল...।”
“কেন দেখা হয়েছিল?”
গলার আওয়াজ এইবার বেশ কঠিন রতন বৈগার। কিছু না বলে চুপ করে থাকে সরস্বতী। “বল গিয়েছিলি কেন...? ”
“দাদা তুইও কি মনে করিস আবদুলের ছোঁড়া বোমাতেই...!”
“ঐ সব কথা এখন থাক।” তড়িঘড়ি বলে ওঠে রতন। আসলে সেও আজকাল মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, আবদুলের বোমায় মরেনি তার বাপ। কিন্তু সে কথা সবাইকে বুঝতে দেওয়ার কোনও মানে নেই। কেটে কেটে বলে, “তুই কি জানিস আজ সকালে আবদুলের বাড়িতে পুলিশ এসেছিল? আজ নয় কাল জেলের ঘানি টানতে হবে ওকে...।”
না, এটা জানে না সরস্বতী। অজানা আশংকায় পায়ের তলায় মাটি দুলতে থাকে ওর।
কেন? পুলিশ কেন! বিশ্বামিত্র কাকার হত্যার ব্যাপারে নাকি হনুমান জয়ন্তীর দাঙ্গার ব্যাপারে!
সাতচল্লিশ
চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।
সনাতন গাজীর বটতলা থেকে ফিরে সুজয় মাহাতো আরও খানিক গম্ভীর হয়ে যান। চেয়ারে বসেই একটা সিগারেট ধরান। দু’একটা টান মারতে না মারতেই আবার ডেকে পাঠান এস আই-কে। এস আই মহাদেবের মুর্মুর রেহাই নেই এই যবনের হাত থেকে।
কিঞ্চিৎ বিরক্ত মহাদেব ঘরে ঢুকলেই নিজের কথা আরম্ভ করে দেন সুজয় মাহাতো, “আচ্ছা মি. মুর্মু, আবদুলের কথা শুনে আপনার কি মনে হল যে খুনটা ঐ করেছে?”
চেয়ারে বসে, টেবিলের উপর রাখা পেপার ওয়েটটা ঘোরান মহাদেব আর ভাবেন, কী বললে ঠিক হবে? সবদিক ভেবে-চিন্তে একটা বেশ ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর দেন তিনি, “বলা মুশকিল স্যার...।”
“যাই হোক, আবদুলের ওভারস্মার্টনেস দেখে আমাদের এটা ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না যে, ও খুনটা করেনি অথবা খুনের বিষয়ে কিছু জানে না।”
মহাদেব সজোরে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলেন, “আমারও সেটাই মনে হয় স্যার। আবদুল যে খুনের সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে, সেটা অতটা গুছিয়ে বলতে না পারলেও, আমি আপনাকে আগেই বলার চেষ্টা করেছি। তবে স্যার খটকা লাগছে একটা জায়গায়... পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী খুনটা হয়েছে গ্লক সিরিজের রিভলভার দিয়ে। কিন্তু...”
“কী কিন্তু!”
“মানে স্যার ভাবছিলাম... এইসব আধুনিক অস্ত্র ওর হাতে আসা কি সম্ভব?”
“বিশ্বামিত্র বাবু কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশে খুন হননি। এর পিছনে একটা সংগঠিত দল আছে।”
“সংগঠিত দল! এটা কেন মনে হচ্ছে স্যার?”
“কেন মনে হচ্ছে সেটা এখনই কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে বলা মুশকিল। তবে, গ্লক সিরিজের রিভলভার—চন্দ্রপুরায় ধর্ম নিয়ে হানাহানি—বিশ্বামিত্র বাবু একজন ধর্মঅন্ত প্রাণ—মন্দিরে খুন...। এইসব দিক থেকে ভাবলে অর্গানাইজগ একটা দলের কথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক।”
“তবে তো স্যার অংক মিলেই যাচ্ছে। পিছনে বড়সড় দল থাকলে গ্লক জোগাড় করে ফেলাটা কোনও ব্যাপারই নয়...।”
মহাদেব মুর্মুকে শেষ করার সুযোগ না দিয়ে ওসি সাহেব তার পরের কথায় চলে যান, “আচ্ছা মসজিদে মরা শুয়োরটা কে ফেলতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”
শুয়োরের বিষয়টা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মুর্মুর। দু-এক মুহূর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার পর মনে পড়ে। তড়বড় করে বলে ওঠেন,
“আমার তো স্যার মনে হয় ওটা সালাউদ্দিনই করেছে। ওই এসব করে এলাকা গরম করছে। স্যার আমার তো চেহারা দেখলেই মনে হয় ব্যাটা একটা আস্ত কসাই। এক কোপে ইচ্ছে করলে মোষের মুন্ডু নামিয়ে দিতে পারে।”
সুজয় এতক্ষণে একটা মনের মত কথা পেয়েছেন, “হ্যাঁ...রাইট...। আমারও তাই মনে হচ্ছে। বাইরের লোক, ঐ মহল্লায় ঢুকে এই কাজটা করার সাহস পাবে না। তবে, মোল্লা সাহেব যদি করেও থাকে সেখানেও একটা প্রশ্ন আছে।”
“কী স্যার ?”
“অ্যাকচুয়ালি... আই থিংক...এই কাজটাও একটা সুপরিকল্পিত প্ল্যানিংয়ের ইমপ্লিমেন্টেশন। এর পিছনে বড় মাথার প্রভোকেশন আছে। আসল উদ্দেশ্য ফুলওড়ারিতোড়ের ধুনকি আশপাশের জোনগুলিতে স্প্রেড করে মবলিঞিং করা। প্রেজেন্ট পলিটিক্যাল সিচুয়েশনটাকে অ্যানালাইসিস করলে এটাই মনে হতে বাধ্য।”
শেষ বাক্যটা বলে চেয়ার থেকে উঠে পায়চারি শুরু করেন মাহাতো। অনেক ভাবনাচিন্তা করে একটা সিদ্ধান্তেই উপনীত হচ্ছেন বারে বারে। নিচু স্বরে সেই ভাবনাগুলোই বিড় বিড় করতে থাকেন, “ইয়েস। প্রভোকেশন এবং গ্লক রিভলভার, দুটোর পিছনেই সংগঠিত একটা দল না থাকলে হয় না...।”
পায়চারি থামিয়ে নিজের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসেন ওসি। ফোনটা তুলে রাধামাধব মন্দিরে একটা ফোন করেন। মন্দির কমিটির হোমরা চোমড়া বলরাম কিস্কুর সাথে একবার কথা বলতে চান। কিন্তু কিস্কুর নাম্বারটা নেই। কাজেই, বলবন্ত সিং এর মাধ্যমে ডেকে পাঠান তাকে।
ফোন হয়ে গেলে রিসিভার নামিয়ে রেখে একটানে ড্রয়ারটা খুলে ফেলেন। বিশ্বামিত্র সেনের ডাইরিটা রেখেছিলেন। তুলে নিয়ে আবার চোখ বোলান। ঘষটাতে ঘষটাতে যদি কিছু উদ্ধার করা যায়।
মি. সেন তো পাগল ছিলেন না, যে আবোল-তাবোল কিছু একটা লিখে রেখেছেন খাতায়। মহাদেব কিছু একটা বলার জন্য উসখুস করছিলেন। সেটা বুঝতে পারেন মাহাতো। বলেন, “কিছু বলার থাকলে বলা যেতে পারে...”
মহাদেব ডাইরিটা নিয়ে পৃষ্ঠা ওল্টান। প্রথম দুটো পাতা সাদা। তিন নম্বর পাতায়, ইংরাজি এ-জি-সি-টি, এই চারটে অক্ষর। সেইগুলি খুব ভালো করে দেখতে দেখতে মহাদেব বলেন, “স্যার আমার মনে হচ্ছে, তিন নম্বর পাতায় ইংরাজি এ-জি-সি-টি, এই চারটে অক্ষরের মধ্যে কিছু একটা ইঙ্গিত আছে। আছেই আছে। অচ্যুত–গদাধর-চিকনকালা-ত্রৈলোক্যনাথ…! কবিতার মধ্যে ভগবান কৃষ্ণের কথা বলা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এই শব্দগুলো কেমন যেন জোর করে ব্যবহার করা হয়েছে।”
“হুমম...সেটা তো আমারও মনে হচ্ছে বার বার, কিন্তু এর বেশি আর এগোতে পারছি কই!”
মহাদেব কে গুরুত্ব দিচ্ছেন সুজয় মাহাতো। আত্মবিশ্বাসে ভর করে পরের কথাটা বলে ফেলেন তিনি, “স্যার আমার মনে হয় অনাদি গোসাঁইয়ের কথাগুলোও আমাদের ভাবা উচিত।”
“ভাবছি তো। সেইজন্যই তো ছুটে গিয়েছিলাম আবদুলের বাড়ি। অনাদি বলেছেন যে, ডি-টাইপ ব্রিজের দাঙ্গা নিয়ে বিশ্বামিত্র ছিলেন স্পষ্টতই উত্তেজিত। আর আবদুল ছিল সেই দাঙ্গায় জড়িত।”
“শুধু কি তাই স্যার? আরও বলেছিলেন , উনি নাকি ইতিহাসকে দিচ্ছেন বিজ্ঞানের আশ্রয়। এর জন্য মরতে হলে মরবেন কিন্তু পিছপা হবেন না।”
সুজয় মাহাতো চেয়ার ছেড়ে টেবিলে আলতো করে হেলান দিয়ে দাঁড়ান। বলেন, “হ্যাঁ, এর থেকে দু'টো জিনিস অনুমান করা যেতে পারে।”
“কী স্যার?”
“এক, সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপের উনি ছিলেন ঘোর বিরোধী, নাহলে ঐ ভাবে রিঅ্যাক্ট করতেন না। অবশ্য যে কোনও শিক্ষিত মানুষই তাই। আর দুই...,যে বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
“কী?”
“দ্বিতীয়ত, এরকম কোনও কাজ উনি করছিলেন, যা ছিল সাম্প্রদায়িক দলগুলির পক্ষে বিপজ্জনক।”
“ঠিক স্যার। আর সে জন্যই, উনি মৃত্যুর আশঙ্কা করেছিলেন। স্যার ওঁর কাজের ডিটেইলিং..., মানে কাজের বিষয় এবং পরিধিটা ঠিকঠাক না জানলে আমাদের পক্ষে এগোনো মুশকিল।”
“সে তো অবশ্যই। তাহলে হয়ত এ-জি-সি-টি জটটাও কাটানো সম্ভব হবে।”
হাজিরা কনস্টেবল ঝিলম মুর্মু আসে, “স্যার বলরাম কিস্কু।”
টেবিলে ঠেসান ছেড়ে সহসা টান টান সুজয়, “পাঠিয়ে দিন।”
দরজায় বলরামকে দেখা যায়, “নমস্কার স্যার। কাছাকাছিই ছিলাম, বলবন্ত সিং ফোন করে বলল আপনি নাকি আমার সাথে কথা বলতে চান। তাই সোজা চলে এলাম...।” বলরাম কিস্কু কথাটা বলতে বলতে মহাদেবের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে।
সুজয় বলরামকে প্রথম যে প্রশ্নটা করেন তা হল, “আচ্ছা আবদুল কতদিন কাজ করছে এই মন্দিরে?”
“অনেকদিন...। হ্যাঁ তা বছর দশেক তো হবেই। তবে…”
অনুসন্ধিৎসু সুজয় এবং মহাদেব।
“তবে!”
“স্যার কিছুদিন ধরে ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলাম। অর্ধেক দিন কাজে আসত না। কিম্বা আসলেও কাজ করত না। অনাদির সাথে খানিক বকবক করে বাড়ি চলে যেত। বলবন্ত সিং, মন্দির কমিটিকে রিপোর্ট করার কথা বললে উল্টে শাসাত। সিং-জিই আমাদের বলেছে, ভার্বালি।”
মহাদেব বলেন, “ইরেসপন্সিবিলিটির জন্য আপনারা ওকে কিছু বলেননি!”
“না। ওকে কিছু বললে বা ছাঁটাই করলে, একটা অন্য রকম খেলা হতে পারত। সাথে সাথে সংখ্যালঘু তাসটা খেলত গাজি বটতলার মানুষ। আমি নিশ্চিত যে, ঐটা যাতে আমরা করি সেজন্যই ও আমাদের প্ররোচিত করছিল। আর...দাঙ্গার পর চারদিকে যা অবস্থা তা আপনাদের থেকে ভালো আর কে জানে!”
বোঝা যায় কতখানি ধুরন্ধর এই বলরাম কিস্কু। কোথায় কোন কথা বলতে হয় খুব ভালো করে জানে। শুধু তাই নয়, মন্দিরের নিরাপত্তা রক্ষী বলবন্ত সিংয়ের নামেও সে মিথ্যা বলল। বলবন্ত আদৌ কিছু বলেনি তার কাছে আবদুল সম্পর্কে। যাই হোক সুজয় বলেন, “ও আপনাদের প্রভোক করছিল!”
“হ্যাঁ তাই। নাহলে ওর মত একটা ডিউটিফুল ছেলে হঠাৎ করে, দিনের পর দিন এ রকম করতে পারে না। সালাউদ্দিনের সাথে মাখামাখির পরই আমূল ভোল বদল হয়ে যায় ওর।”
“সালাউদ্দিন কে আপনি কতটা চেনেন?”
বলরাম কিস্কু চোখ বিস্ফারিত করে, “সালাউদ্দিনকে এলাকার কে না চেনে! ওয়াশিপুর আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে আজকাল বেশ ভালো রকম ওঠাবসা আছে শুনেছি। আজ্ঞে আপনি ‘গ্যাং অফ ওয়াসিপুর’ দেখেননি! পুলিশে কাজ করেন। দেখা উচিৎ স্যার।”
হাওড়া থেকে চন্দ্রপুরা যাওয়ার পথে ফুলওড়ারিতোড়ের খানিক আগেই ওয়াসিপুর। যেখান কার অন্ধকার জগতের কুখ্যাতি দুনিয়া জোড়া। তবে এখন এই সব আগবাগডুম কথা বলে বিষয়বস্তুটাকে গুলিয়ে দেওয়াই আসল উদ্দেশ্য চতুর বলরামের। তবে সুজয়ও ঘাগু অফিসার। চিবিয়ে বার করেন পরের বাক্য, “আমার প্রশ্নটা আপনি বুঝতে পারেননি বলরাম। সালাউদ্দিন আর আপনি, দুজনেই শান্তি কমিটিতে আছেন, সেটা আমরা জানি। কাজেই চিনবেন তো বটেই। আসলে জানতে চাওয়া হয়েছে কতটুকু চেনেন?”
নাটকীয় ভঙ্গিমা বলরামের, “ছিঃ ছিঃ স্যার কী যে বলেন ! আপনারা জানবেন না তো কে জানবে? যাই হোক, সালাউদ্দিন মুসলিম সংগঠনের বড় নেতা। কেউ কেউ বলেন, ওর নাকি মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলির সাথেও যোগাযোগ আছে। ডি-টাইপ ব্রিজে যে গোলমাল হয়েছিল, সেখানে সালাউদ্দিন এবং আবদুল দুজনেই ছিল। আমি নিজে দেখেছি।” আবার প্রসঙ্গে বেনোজল ঢোকাবার চেষ্টা বলরাম কিস্কুর, “আজকাল তো সাল্লুর ওয়াসিপুর গ্যাংস্টার তেও বেশ খানিক দহরম মহরম হয়েছে। ঐটাই নাকি আর্মসের সাপ্লাইলাইন...স্যার।”
ওয়াসিপুরের হাল হকিকত খুব ভালো করে জানেন দারোগাবাবু। ওখানে যে গ্যাং-ওয়ারগুলো হয়, সেখানে কোথাও গ্লক ব্যবহার হয়েছে, এইরকম কোনও তথ্য পুলিশের কাছে নেই। সবই মূলত পাইপগান কিম্বা ওয়ান-শর্টার। কাজেই বলরামের কথাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে পরের বাক্যে দারোগা সাহেব,“আচ্ছা মিস্টার বলরাম, এত কিছু জেনেও সালাউদ্দিনের সাথে আপনি শান্তি কমিটিতে আছেন কেন?”
একটু থেমে খুলে খেলতে শুরু করে বলরাম, “যে শান্তি কমিটির কথা আপনি বলছিলেন, সেটা একটা লোক দেখানো ব্যাপার ছাড়া কিছুই নয়। রাখা হয়েছে তাই আছি। আসলে ওদের চটাতেও বেশ ভয় করে স্যার। এখন দুম করে ছেড়ে দিলে...হে হে বুঝতেই পারছেন স্যার...।”
সত্যি পাকা খেলোয়াড় এই বলরাম কিস্কু। দারোগার উল্টো প্যাঁচ, “রিয়েলি? যাই হোক, দাঙ্গার দিন আবদুল যে স্পটে ছিল, সেটা সিয়োর ছিলাম বাট্ সালাউদ্দিন যে স্পটে ছিল সেটা জানতাম না। কোনও সময় সাক্ষী দেবার প্রয়োজন হলে দিতে পারবেন তো?”
এইবার একটু ভেবলে যায় বলরাম। কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিল সে, এই সময় ঝিলম আসে আবার, “স্যার একটা মেয়ে এসেছে। আপনার সাথে দেখা করতে চায়।”
“মেয়ে! কী নাম?”
“স্যার নাম বলল সরস্বতী বৈগা। গাজি বটতলার পাশেই থাকে বলল। ফুলওড়ারিতোড় বৈগা পাড়ায়।”
“সরস্বতী বৈগা!”
কে এই সরস্বতী বৈগা ! ডি টাইপ ব্রিজের দাঙ্গায় খুন হয়ে যাওয়া পরমেশ্বর বৈগার কেউ নয় তো? সে থানায় আবার কী মনে করে!
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন