কয়েক দফা গেট পেরিয়ে, আইডি কার্ড দেখিয়ে সাঁইত্রিশ নম্বর বারের আটষট্টি নম্বর সিটে পৌঁছে রুবি আবার সেই হাসিটাই হাসল। ব্রিটিশদের বানানো বিশাল হলঘরটা সাঁইত্রিশ নম্বর বার। তাতে তিন-চার সারি টেবিলের দুদিকে অজস্র চেয়ার, তারই একটা আটষট্টি নম্বর। ঘরের ভিতরে আলো যেন কমে আসছে! অনেক নাটক করেছে, কিন্তু কোনোদিন নামকরা উকিলদের বসার জায়গার সেট দেখেনি রুবি। এ তো থিকথিক করছে, কালো কোট, সাদা প্যান্ট। কয়েকজনের গায়ে কালো আলখাল্লার মত, ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’ যাকে শামলা বলা হয়েছে। আনন্দবাবু এদের থেকে আলাদা কী এমন? পারবে, মেয়েটাকে বেল করিয়ে দিতে? জজসাহেব গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন, এর কথা? তার থেকে রুবি চলে যাক! রাশির যা হয়, হবে। ওর কিছু ভাল লাগছে না।
ভিক্টরকে স্কুলের সামনে নামিয়ে দিয়ে রিক্সাটা স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছে। এগারোটা সতেরোর ট্রেনটা ধরতে হবে। টার্মিনালে নেমে সোজা হাইকোর্ট। দেখা যাক, আনন্দবাবুর সঙ্গে দেখা করা যায় কিনা! ফোনে গলাটা এত রাগী লাগল! ইদানীং ভদ্রলোকের নাম হয়েছ! টিভিতেও মুখ দেখা যাচ্ছে। জাজরা নাকি, অভিজ্ঞ ল-ইয়ারদের কথাকে গুরুত্ব দেয়! স্কুল-কলেজের একগাদা কেস লড়ে অথরিটিকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন তিনি। সময় দিয়েছেন বারোটা নাগাদ। ওখান থেকে বেরিয়ে একবার বই-মার্কেটে যেতে হবে। মিষ্টুর জন্য একটা রেফারেন্স কিনতে হবে! মেয়েটার মাথা খুব ভাল! যদি শহরের নামকরা ইংরেজি স্কুলে পড়ত, চাপে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়ত আরও এগোতে পারত! কিন্তু বাজারের ফুলওয়ালার মেয়ে কীভাবে এই মফসসল থেকে শহরের স্কুলে যাবে? চেষ্টা অবশ্য করেছিল মিষ্টুর মা-বাবা। নতুন আইনে নাকি গরিব ছেলেমেয়েরাও বড়লোকদের স্কুলে পড়তে পারে। রঙচঙে জামা-জুতো-টাই আর কচরমচর ইংরিজির স্কুলগুলো বলেছিল... সুপারিশ লাগবে। এখানে বলরামবাবু ছাড়া আর কে সুপারিশ করতে পারে? মিষ্টুর বাবা-মা সেখানেও গিয়েছিল। বলরামবাবু ছিলেন না। একদিন পরে পিএ-এর ফোন এসেছিল, ‘কিছু দিতে হবে যে! এতকিছু সেবার কাজ চলে। স্যার তো যা ভাতা পান, সবই ঐ সেবার কাছেই দিয়ে দেন।’
মিষ্টুর বাবা, বলেছিল, ‘দেব স্যার! নিশ্চয়ই দেব। এতবড় একটা উপকার করে দেবে আমাদের দাদা। কখন দিতে হবে?’
‘আগে শুনে নিন। এক...মত লাগবে।’
‘একহাজার? ফুল বেচি বাজারে। তাও দেব। কখন যাব?’
‘ওটা হাজার না, লাখ! শুনেছেন ভাল করে।’
কেঁদে ফেলেছিল মিষ্টুর বাবা…
‘আচ্ছা, দাঁড়ান দেখছি কী করতে পারি? ফর্মটা রেখে গেছেন তো? ফর্মে বাচ্চার মায়ের ছবি দেওয়া আছে তো?’
‘হ্যাঁ স্যার! একটু দেখবেন।’
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
দিনতিনেক পরে পি এ ফোন করল,
‘কাল, না না পরশু বৌদিকে রাত আটটা নাগাদ পাঠিয়ে দেবেন?’
মিষ্টুর বাবা মনে মনে ঠাকুর প্রণাম করতে করতে উত্তর দিয়েছিল,
‘আচ্ছা স্যার। আমি সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই চলে যাব।’
‘আরে, আপনাকে কে আসতে বলেছে? মিসেসকে পাঠাবেন।’
‘আজ্ঞে?
‘শুনতে পাননি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কাগজটাই তো আনতে হবে, আমি গেলে হবে না? তাছাড়া রাতের রান্না…’
‘একদিন আপনি রান্না করতে পারবেন না? মেয়েদের আর কত বন্দি করে রাখবেন ঘরের মধ্যে?’
‘স্যার, মেয়েছেলে, ঐ রাতে একা একা যাবে?’
‘রাত? আটটা তো সন্ধে! আপনি কী বলছে বলুন তো? এই টাউনে, এই টাউন কেন টাউন আর ব্লক মিলিয়ে পুরো কনস্টিটিউয়েন্সিতে রাতে-দিনে, মেয়েদের দিকে তাকাতে কেউ সাহস পায়? আগেকার দিন নেই আর। এই একযুগে বলরামদার আমলে কোনো কমপ্লেন, কেউ করতে পারবে? সাহস আছে? বৌদিকে পাঠাবেন। আপনার আসার দরকার নেই। এখানে জায়গা কম। আর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে পুলিস ধরবে। দাদার জেড সিকিউরিটি। ধরে ফেললে আমরা কিছু করতে পারব না। দেরি হবে, এগারটা-বারোটা বাজবে। ভাববেন না। আমাদেরই মেয়েরা কেউ না কেউ গিয়ে পৌঁছে দেবে।’
অনেক পরে এসব জেনেছিল রুবি, বলেছিল,
‘একবার জানতে চাইলেন না? বৌদিকেই কেন লাগবে?’
‘বলল, এমনিতে হবে না। মেয়ের মার ইন্টারভিউ নেবে স্কুলে। আজকাল মায়েদের দেখেই বড় স্কুলে ভরতি নেয়। সুপারিশ থাকলেও ইন্টারভিউতে পাশ না করতে পারলে ভর্তি হবে না। দাদা যখন সুপারিশ করেছে, ভর্তি করাতেই হবে। তাই তো দাদাই টাকা খরচা করে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেছে। বাইরে থেকে লোক আসবে ট্রেনিং দিতে। আরও নাকি দু-একজন আছে এরকম।’
রুবি ঠিক সেই সময় তাকিয়েছিল মিষ্টুর মায়ের মুখের দিকে, শ্যামলা রঙের পানপাতা মুখে গনগনে কয়লার লাল-আভা, ‘রুবিদি, বাড়িতে যা পড়াবে তাতেই আমার মেয়ের উন্নতি হবে। আমাদের বাংলা ইস্কুলই ভাল।’
রুবি বলতে চেয়েছিল, ‘না, না…অতবড় কনভেন্ট স্কুলের টিচারদের পেলে, মেয়েটার খুব উন্নতি হত যে!’
কিন্তু বলতে পারেনি! মিষ্টুর মায়ের আগুন-মুখের ঠোঁটদুটো থরথর করে কাঁপছিল, চোখদুটো টলমল করছিল। সেদিন চলে আসার সময় রুবি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বৌদি, দাদা কি কথাগুলো রেকর্ডিং করে রেখেছে?’
‘এত প্যাঁচ-ঘোঁচ নিয়ে তো আমরা চলি না। আমাদের চিন্তা, গঙ্গার হাট থেকে ফুল আনা, মালা গাঁথা, বিক্রি আর মেয়েটার লেখাপড়া। তবে ভাববেন না দিদি… লোহার খুন্তি আছে, গ্যাসে গরম হয় একমিনিটে। একবার আসুক!’
মিষ্টুদের বাড়িতেও টিভি আছে। বাইরের ঘরটায় বসে মিষ্টুর মা কখনও কখনও সিরিয়াল দেখে। না, সিরিয়ালের আজগরটা সবাইকে গিলতে পারছে না।
এখনও মিনিট সাতেক বাকি ট্রেন আসতে। সিমেন্টের বেঞ্চে বসার জায়গা পেল রুবি।
‘আরে রুবি! এ কী রে তোর মুখটা এমন পোড়া পোড়া লাগছে কেন রে? কী হয়েছে রে? শরীর খারাপ?’
প্রীতিকণা, স্কুলের বন্ধু। ছোট টাউনে এই একটা সমস্যা, যেখানেই যাও চেনা কারুর না কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবেই। সত্যি বলতে গেলে, রুবির কাছে এটা আসলে সমস্যা না। কিন্তু ও বুঝতে পারছে, ওকে শিগগির ওষুধ কিনতে হবে। মুড-সুইং আবার ফিরে এল মনে হচ্ছে। আজ সকাল থেকেই দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছিল। ভিক্টর নেমে যাওয়ার পর মনে হচ্ছিল রিক্সা ঘুরিয়ে ফিরে যাবে বাড়িতে। কিন্তু ফিরে গেলে রাশিটার কী হবে? ঐটুকু মেয়েটা… এত সাহস দেখিয়ে এগিয়ে এল!
মিষ্টুর মার কথা, মিষ্টুদের কথা ভাবতে ভাবতে একটু ভাল লাগছিল। যতই খারাপ লাগুক, মুড সুইং হলে সব সামলে ও কাজ করে যায়। কত শো করেছে, হাততালি পেয়েছে, কেউ বুঝতে পারেনি দেখে, আর ঠিক সেই সময় ওর মনে হচ্ছে, দৌড়ে কোনো অন্ধকার জায়গায় চলে যায়। স্টেশনের লোকজন, চারিদিকের হৈচৈ ওকে আরেকটু রিলিফ দিল। কিন্তু প্রীতিকণা? ওহ, গসিপ গার্ল! এমন বকবক করবে না! মাথার দুপাশের রগ আরও জোরে দপদপ করতে শুরু করল।
‘রুবি তোকে ভিডিওতে দেখেছি রে! কিন্তু সেখানেও তো এত কালো লাগছিল না, কী হয়েছে? রাতে ঘুমোচ্ছিস না? বাইরে যা করছিস কর, বাড়িতে এসব ঢোকাস না, বুঝলি?’
পাশেই ফাঁকা জায়গা। প্রীতিকণাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না, সে বসবে কিনা। রুবি উঠে দাঁড়ায়,‘তুই কি আমার সঙ্গেই…’
রুবিকে থামতে দিল না মেয়েটা,
‘না রে! উপায় আছে? শাশুড়ি জানলে না!… ঢুকতে দেবে না বাড়িতে। বামুনের বাড়ি, মঙ্গলচণ্ডীর ঘট আছে! এখন তো আমাকেই পুজো করতে হয়। ওসব মিছিলে সাতজাতের লোক, তার ওপরে কোনটা মোল্লা, কোনটা খ্রিস্টান। আমার কিন্তু যীশুকে খুব ভাল লাগে! একেবারে রিতিকের মত দেখতে, তাই না? তুই আবার রাগ করলি নাকি? শোন না, আমি না গেলে কী হবে, তুই আমাদের সবার গর্ব! আছি তো তোর সঙ্গে, টাকাপয়সা লাগলে বলিস, ফোনপে করে দেব। ছাড়বি না, একদম…ঐ দেখ আপের ট্রেন ঢুকছে, আমি গেলাম। ব্রিজ দিয়ে ঊঠতে হবে রে…কোমরে খুব ব্যাথা। জানাস কিন্তু… কুকুরের বাচ্চাগুলোকে ছাড়বি না…’
কুকুরের বাচ্চা! একটু জোরেই বলে গেল প্রীতিকণা। কিন্তু বাচ্চা কুকুরেরা, না না কুকুরেরা কি কোনোদিন দল বেঁধে, জোর করে, আনন্দ দিতে পারবে না, অক্ষম এমন কোনো কুকুরীকে, চলন্ত ট্রেনে সবার সামনে নির্যাতন করে? প্রমাণ না রাখার জন্য যাত্রীদের সবার ফোন কেড়ে নেয়। তারপর আরও আনন্দ পেতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করে!...করে কি? তাহলে কুকুরদের সঙ্গে মানুষের চামড়ায় ঢাকা জন্তুগুলোকে তুলনা কেন করে গেল প্রীতিকণা? অন্যায় করে গেল মেয়েটা। হেসে ফেলল রুবি। এই হাসি, ওর ট্রেডমার্ক হাসি না। বড় থিয়েটার গ্রুপ ওকে ডেকে নেয় যে রোলটার জন্য সিরিয়ালের চেনা মুখ এলে তাকে সেই রোলটা দিয়ে দেয়। সেইসময় এমনই একটা হাসি আসে ওর মুখে, ওকে অন্ধকার ঘরের দিকে ডাকে? চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছা করে? তবে ও কি নিজেও জেনে, না জেনে মনে মনে নোংরা লোকেদের, কুকুর, শুয়োর বলে গাল দেয়নি? ও কি চলে যাবে এখন বাড়িতে? না, এবার ডাউনের ট্রেন ঢুকছে।
কয়েক দফা গেট পেরিয়ে, আইডি কার্ড দেখিয়ে সাঁইত্রিশ নম্বর বারের আটষট্টি নম্বর সিটে পৌঁছে রুবি আবার সেই হাসিটাই হাসল। ব্রিটিশদের বানানো বিশাল হলঘরটা সাঁইত্রিশ নম্বর বার। তাতে তিন-চার সারি টেবিলের দুদিকে অজস্র চেয়ার, তারই একটা আটষট্টি নম্বর। ঘরের ভিতরে আলো যেন কমে আসছে! অনেক নাটক করেছে, কিন্তু কোনোদিন নামকরা উকিলদের বসার জায়গার সেট দেখেনি রুবি। এ তো থিকথিক করছে, কালো কোট, সাদা প্যান্ট। কয়েকজনের গায়ে কালো আলখাল্লার মত, ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’ যাকে শামলা বলা হয়েছে। আনন্দবাবু এদের থেকে আলাদা কী এমন? পারবে, মেয়েটাকে বেল করিয়ে দিতে? জজসাহেব গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন, এর কথা? তার থেকে রুবি চলে যাক! রাশির যা হয়, হবে। ওর কিছু ভাল লাগছে না।
সাদা চুল, সাদা মোটা গোঁফ, কুচকুচে কালো রঙের চামড়ায় ঢাকা মুখে বেশ লাল চোখ। আনন্দবাবু চেয়ারে বসেছিলেন। হাত দুয়েকের মধ্যে রুবি দাঁড়িয়েছিল। রুবি ঘুরে দাড়াতেই লোকটার খ্যানখ্যানে গলা বেজে উঠল,
‘আরে বসুন না ঐ চেয়ারটায়। তারপর বলুন।’
রুবি বসে পড়ল। টিউবগুলোর আলো, যেন স্টেজের স্পট-লাইটের মত নিভে আসছে। বলতে ইচ্ছা করছে না। তবুও রাশির মুখটা ভেসে উঠছে বারবার। যাহয়, হোক…বলতে হবে। ও বলতে শুরু করল। একটু পরে খ্যানখ্যানে সেই আওয়াজ ওর বলার ঘোর ভাঙল,
‘সাতশ তেরোর তিন ধারা, দিয়েছে? জানেন? নোটিশ এনেছেন?’
‘না, শুনেছি?’
‘শুনেছেন? আর শুনেই চলে এলেন?’
‘ওকে যে যেতে হবে, ছ তারিখ রাতে থানায়!’
‘যাবে।’
‘আর গেলেই যদি ধরে নেয়?’
‘নিতে পারে, নেবেই…আই মিন, যা ধারা দেওয়া আছে, এখনও ছেড়ে রেখেছে, এটাই অনেক।’
‘কিন্তু আপনি তো জানেন, সব মিথ্যে, উলটে ওরাই মার খেয়েছে, দেখলেন তো ভিডিওটা!’
‘আপনাদের একটা এফ আই আর করা উচিত ছিল।’
‘এখন তাহলে করব?’
‘না, না…এখন বাদ দিন, সে জজসাহেবকে আমরা বলব। আচ্ছা দাঁড়ান, দাঁড়ান… খেয়াল করিনি তো, এই কেস তো এখানে হবে না! পুলিস কোর্টে যাবে!’
লোকটা এবার সরাসরি রুবির মুখের দিকে তাকাতে শুরু করেছে। ওর থুতনির নীচের তিলটা কি লোকটার খুব পছন্দ হল?
‘মানে, আমি ত সেসব জানি না। টিভিতে দেখেছিলাম আপনি গরিব ছেলেমেয়েগুলোর জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। এই মেয়েটাও খুব গরিব!’
‘কে হয় আপনার?’
‘কেউ না, আমায় ভালবাসে।’
লোকটা চোখের মণি স্থির, ‘মক্কেল আপনার ব্লাড রিলেশান না, আর আমি কথা বলছি আপনার সঙ্গে! যাক… যাব, নীচের কোর্টে। কিন্তু চার্জ বেশি লাগবে।’
কিছুতেই আর থাকতে ইচ্ছা করছে না রুবির তবুও বলল,
‘চার্জ?... কত?’
‘দাঁড়ালে…সাত হাজার। এক হাজার বেশি দেবেন। আর ট্যাক্সি ভাড়া। নিজেরাও গাড়ি করে নিয়ে যেতে পারেন। তবে আমার বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হবে।’
‘আট হাজার…’
রুবির সব তেতো লাগছে। আগের মত কন্ট্রোল করতে পারছে না কেন? ও উঠে পড়ল। কাছাকাছি ওষুধের দোকান আছে?
‘আরে, ফিসটা দিয়ে যান।’
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে একেবারে রুবির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার মুখ থেকে কি পচা গন্ধ বেরোচ্ছে?
‘ফিস? আপনি তো ফোনে কিছু বললেন না?’
‘আপনি তো প্রাইভেট টিউটার, একদিনও মিনি-মাগনায় পড়ান? আমাদের ঘর সংসার নেই? দু-হাজার দিন।’
রুবিকে যেভাবেই হোক এখন বেরোতে হবে,
‘আমার কাছে হাজার আছে।’
মিষ্টুর বই কেনার জন্য হাজার টাকা নিয়ে বেড়িয়েছিল। এ মাসের জন্য আর কটাকা আছে বাড়ির পার্সে? রুবি মনে করতে পারছিল না।
‘আচ্ছা তাই দিন। বাড়ি গিয়ে বাকিটা ফোনপে করে দেবেন। আমার একটাই নাম্বার। ওটাতেই ফোনপে আছে।’
রাজধানী শহরের মানুষ আর গাড়ির ভিড় সরিয়ে কীভাবে যে বই-মার্কেটে এল, রুবি নিজেই বুঝতে পারছে না। এখনও ওষুধের দোকান খুঁজে পায়নি। মিষ্টুর বইটা কিনতে না পারলেও একবার দেখে নিতে হবে। আজ আর সমাবেশে যাবে না রুবি। সোজা বাড়ি, কিছুই আর ভাল লাগছে না। দরকারে কালই একটা ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। কিন্তু রমাদি দাঁড়িয়ে আছে যে! ফোন না করলে দাঁড়িয়েই থাকবে। কাঁধের ঝোলা লেডিস ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে ও।
ঘাড়ে একটা অদ্ভূত ধাক্কা। ছিটকে পড়তে পড়তে সামলে নেয়। তারপর অবাক হয়ে দেখে, ওর ফোনটা কেড়ে নিয়েছে একটা লিকলিকে লম্বা লোক। হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে ওর ফোনটা স্ক্রল করছে। ও দৌড়ে গিয়ে লোকটার টি-শার্টের কলার চেপে ধরে। স্কুল লেভেলে জুডোতে ও একবার চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল। লোকটার মুখে ব্যথা, যন্ত্রণা, ভয়…কোনোকিছুই দেখতে পেল না, রুবি। ফোনটা ওর হাতে দিয়ে, মুখটা কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,
‘এখানে ফোন কেড়ে নিচ্ছি, আর টাউনে কী করতে পারি, বুঝতে পারছ? চেপে যাও। টাইম আছে।’
সঙ্গেসঙ্গেই যেন উবে গেল লোকটা। পাঁইপাঁই করে দৌড়ে কোনদিকে গেল, কিছুই বুঝতে পারল না রুবি। মিনিটখানেকের মধ্যে রুবির সামনে দুশো বছরের পুরোনো বই-রাস্তায় দুপুর তিনটের মেঘলা দুপুরে কয়েকহাজার স্ট্রিট-লাইট জ্বলে উঠল! ও সারা শরীর দিয়ে চিৎকার করে উঠল। আঁ…আঁ! না, অভিনয়ের টেকনিকে মাইকে আওয়াজ পৌঁছোনোর চিৎকার নয়। শহরের পুরোনো-নতুন অট্টালিকা থেকে রাস্তার ধুলোর প্রত্যেকটা কণা সে চিৎকারের ধাক্কায় কেঁপে উঠল। ফুটপাতের আসা-যাওয়া করা লোকেরা, বই দোকানি, পড়ুয়া, ঝোলা ব্যাগের কবি, লাল-নীল শরবতের ঠেলাওয়ালা সবাই অবাক চোখে দেখছে ওকে।
পালিয়ে যাওয়া লোকটার জন্য রাগ, ঘেন্নার থেকেও নিজের জন্য স্বস্তি হচ্ছে রুবির। চেঁচাতে পেরে ও যেন বেঁচে গেল। আরও চেঁচাবে সে। রাস্তাটাই এখন স্টেজ। সত্যিকারের স্টেজ। আশ্চর্য এই প্রথম স্টেজের মধ্যেই, পালিয়ে যাচ্ছে মুড-সুইং। হাতঘড়িতে তিনটে পাঁচ, ও যাবে জমায়েতে। যে যাই ভাবুক। আশ্চর্য এত চেষ্টা করল ‘জমায়েত’ শব্দটা মাথা থেকে মোছা গেল না।
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন