এই অনন্ত মানুষের মিছিল, এই সমাজ, এই সভ্যতা, এই যে বহমান জীবন, এইসব যা কিছু, সবই তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানারকমের কয়েদ। কোনোটা বদ্ধ, কোনোটা খোলা... অদৃশ্য বেড়ায় ঘিরে রাখা মুক্ত ‘সেল’। ছোটবড় ইত্যাদি অজস্র ‘কাস্টডি’র ভেতরে কিম্বা বাইরে আমরা সবাই রাশি... রাশিদা খাতুনের মত অপেক্ষায়। জামিন মিলবে? শহর-ঘেরাটোপ পেরিয়ে, কুচকুচে কালো আকাশ— জেলখানাটার ভয় মুছে দিয়ে ‘অর্ধেক আকাশ’ রাশি, রাশির মত মেয়েদের জামিন হবে— আদৌ? শুরু হল জামিন। রাজেশ ধর-এর ধারাবাহিক উপন্যাস।
পেটের ভেতরটা কি বাইরে বেরিয়ে আসবে? অটোর ব্যাকসিটে মাঝখানটায় বসে আছে রাশি। দুপাশে দুজন মাঝবয়েসি লোক, ভারী চেহারা। ড্রাইভারের পাশের সিটের প্যাসেঞ্জার এখনও আসছে না। প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল। মাঝ আগস্টের এই গুমসানি গরম আর দুজনের চাপে, ঘামতে ঘামতে দম আটকে আসছিল। নেমে গেলেই ভাল হয়। অন্যদিন হলে নেমেই যেত। নাপিতপাড়ার মোড় অবধি হাঁটলে মিনিট সাতেক। সেখানেই বাসরাস্তা। বেহালা-টালিগঞ্জ অটোর লম্বা রুটও ঐ রাস্তায়। দাঁড়ালে দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলতি অটো পাওয়া যায়। তার ওপর নাপিতপাড়া-টালিগঞ্জ অটোরুটও ওখান থেকেই শুরু। কিন্তু এই সাতটা মিনিটও রাশি বাজে খরচা করতে চায় না। অভিজিৎদা বারবার হোয়াটস অ্যাপ করছে। তাড়াতাড়ি আয়, তাড়াতাড়ি আয়। কী করবে সে? আর একজন এসে গেলেই অটো ছেড়ে দেবে। এখন সন্ধে-রাত, তাই উলটো দিকে বাড়ি ফেরত অফিসযাত্রীর ভিড়। তারা টালিগঞ্জ বা বেহালা হয়ে বাড়ি ফিরছে। রাশি যেদিকে যাবে সেদিকে গাড়ির চাপ কম। অটো ছাড়লে আট-দশ মিনিটের মধ্যেই টালিগঞ্জ।
মেসেজ টোন বেজে উঠল। ওহ্, তার সাথে আবার পেটের ভেতর থেকে সেই হড়হড়ে বমির টান। মার খেয়ে বাড়ি আসার পরদিন সকাল থেকেই ধিকধিকে গা-গোলানি চলছে। অটোতে ওঠার ঠিক আগে থেকে অসম্ভব, অসহ্য হয়ে উঠল। একটু বুঝতে পারলে পার্সের মধ্যে বমির ট্যাবলেটের পাতাটা ভরে নিত। এই কদিন বারকয়েক তো খেতে হয়েছিল! আবার টোনটা বাজল। সেই অভিজিৎদার মেসেজ। এবার অন্য কথা…
‘আশেপাশে নজর রাখবি’।
তার মানে? এই লোকদুটো কি…? ওহ! আব্বা গো! এবার কি বমি করেই ফেলবে রাশি? আল্লাহ… পাড়ায়, আশেপাশে কেউ তো কিছুই জানে না! জানতে পারলে পরশুর আগের রাত থেকে আজকের এই সন্ধেরাতটুকুর মধ্যে কেউ ওকে ছেড়ে দিত? পারুল পিসির কী হয়েছিল? কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব জানাজানি হয়ে গেল। কাউন্সিলার, ক্লাবের দলবল বাড়িতে এসে হাজির।
না, না…এই লোকদুটো নিশ্চই না। কিন্তু দুজন, দুদিক থেকে আরও চাপছে কেন? বাঁদিকের লোকটার কনুই এবার ওর বুক ছুঁয়েই ফেলবে। আর ডানদিকের লোকটা নিজের বাঁহাতটা একেবারে সিটের ওপর ভর দিয়ে রেখেছে। এমনভাবে তো কেউ রাখে না! বুকের ওপরেই মোটামুটি জড়ো করে রাখে। তবে বুকে গুঁতো ঠিক মেরেই যায় কাকু-জেঠুরা। কী করবে রাশি? চেঁচিয়ে উঠবে? ড্রাইভারগুলো মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। নিশ্চই চলে আসবে। কিন্তু প্রথম যেদিন এই শীতলামন্দিরের মোড়ে ‘রাত-দখল’ নামের সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটে গেল। যা শেষ হওয়ার পরেও রাশি বিশ্বাস করতে পারছিল না... সত্যিই কি এতক্ষণ ধরে যা হল, সেই সবকিছু চোখের সামনে ঘটে গেল? ও নিজেও কি সত্যি সত্যি অত, অত চেনা-অচেনা মেয়ে-মহিলাদের মধ্যে মিশে গিয়ে, মনের সাধ মিটিয়ে চিৎকার করতে পেরেছিল? যে রাগগুলো... যে রাগগুলো... থাক সেসব কথা, জবাই করা খাসির যন্ত্রণা বুকের পাঁজরের নীচে নিয়েও স্বপ্নের মত সেই মাঝরাত্তিরে শেষে ও, মেজ বোনটা, পারুল পিসিরা, যখন ফিরে আসছিল পাড়ায় তখন ঐ, ঐ যে... হলুদ টি-শার্ট পড়া ড্রাইভারটা থুতু দিয়ে ছুড়ে ফেলল বিড়ির টুকরো, ঐ লোকটাই তো বাঙালগলির মুখটায়, বলে গিয়েছিল ‘…আবার যদি এইভাবে রাত মারাস, তবে পরের রাত তোদের ... মারাতে হবে।’
ভোটের দিন ঐ লোকটাই স্কুলের গেট থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল না?
‘ভোট হয়ে গেছে…বাড়ি যা, বাড়ি যা!’
তার মানে ওরা, এই লোকগুলো সব একসঙ্গে…? আল্লাহ! ...কী হবে? কে বাঁচাবে? আবার মেসেজ টোন? বমি হয়েই যাবে। ওক্ উঠে আসছিল রাশির। দুই হাতে মুখ চেপে ধরে মাথাটা নীচু করল সে।
কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
অটোটা ঘ্যারঘ্যার করে উঠল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ঠান্ডা হাওয়ার কয়েক চিলতে রাশিকে ছুঁয়ে যেতে শুরু করল। নাহ্… বমি হয়নি। অনেক অনেক কষ্টে বমি চেপে রেখেছিল রাশি। মাথার ভেতরটা একটু হালকা লাগছে। ধীরে ধীরে মাথা তুলে উপরের দিকে তাকায় সে। নাহ… হলুদ গেঞ্জির ড্রাইভারটা চালাচ্ছে না। একেবারে মিহি করে ছাঁটা, প্রায় কামানো চুলের চওড়া মাথার পেছনদিকটা দেখা যাচ্ছে। এই ছেলেটাকেও চেনে রাশি। ক্যাটকেটে সবুজ শার্ট, পিঠের দিকে কলারের নীচে একটা খুব ছোট্ট পকেট। ওর বাঁ পাশে যে বসেছে তার গলার স্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে, বয়সে সে ড্রাইভারের থেকে বড়। দুজনে একনাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে প্যাসেঞ্জার, ড্রাইভারের চেনা। রাশির পেটের মধ্যে ফের হালকা হালকা গুলিয়ে ওঠে। বমি-জ্বিনটা কি আবার জেগে উঠবে? মনিকাদির কথা মনে পড়ল। কাল দুপুরেই ফোন করেছিল। পিয়ার জ্যাঠতুতো দিদি সাইকোলজি নিয়ে রিসার্চ করছে। বলেছিল, ‘…মাথা ঠান্ডা রাখবি। আর যতটা সম্ভব অন্যদিকে মন ঘোরাতে চেষ্টা করবি। অন্য লোকের কথা শুনবি। টিভিতে সিনেমা দেখ, গান শোন যেমন ইচ্ছে তোর। মাথার মধ্যে যা ঘুরছে তা ভেসে উঠতে দিবি না। পিয়াকেও একই কথা বলেছি…’
রাশি শুনতে পাচ্ছে, ‘ধুর শালা…কিছু না, সবই ঠিক আছে। তাও দেখ, কেমন যেন মনটা খারাপ! বাড়িতে, রাস্তায়, স্ট্যান্ডেও সেই কথা হচ্ছিল!’
‘সে কী রে! হেবলে বুড়ো এইসব শুনলে তোকে ইউনিয়ানে রাখবে?’
‘মাসিমার ছেলের কথা আর বোলো না, কাবুদা! ভবেনদা জেলায় যাক। ওকে লাথ মেরে বার করে দেব না, স্ট্যান্ড থেকে!’
‘আরে আস্তে বল, দলের লোক শুনলে…’
দুজনেই গলা নামাল। গাড়ি এখন মেনরোডে। রাশিদের অটোর সাথে আরও অটো, ট্যাক্সি, বাইক, বাস, লরি…কত যে আওয়াজ! রাশি ওদের কথা আর শুনতে পাচ্ছে না। পেট গোলানো কষ্টটা বারবার ভেসে উঠতে চাইছে। ও বাইরের দিকে তাকায়। সিদ্ধেশ্বরীর মোড়ের সিগনালে অটোটা দাঁড়িয়ে গেছে। আর দুটো স্টপ পরেই টালিগঞ্জ। নিজেকে বেশ শক্ত করে রাশি। দুইহাতের পাতা দিয়ে তলপেট চেপে ধরে। ড্রাইভারটার গলা আবার শোনা যায়,
‘দেবে? … দেবে দিক, বার করে দিক। কী হবে বাল? চারচাকা চালাব। দম কারুর কম নেই। তিনমাসের মেয়ে ঘরে। ও বড় হলে, তখন কী হবে?’
‘সত্যি ভাই, আমারও মেয়েটাও তো এমবিএ পড়ছে! ভাগ্যিস ব্যাঙ্গালোরে। এখানে থাকলে কী হত? কী হচ্ছে বলুন দেখি?’
রাশির বাঁদিকে বসা মোটা লোকটা বলে উঠল। রাশি চেষ্টা করে মুখটা দেখতে। মাকুন্দমার্কা সাদামাটা মুখ, চোখে মোটা চশমা। মাথায় আধটাক। তার ডানকনুই এখনও ওর বুকের বাঁদিকে চাপ দিয়ে রেখেছে।
‘আঙ্কেল, আমি তো ঠিক করেই রেখেছি। মেয়েকে এখানে রাখব না। বাইরেই পাঠিয়ে দেব।… সবাই কিন্তু খুচরো দেবেন।’
টালিগঞ্জ এসে গেছে। রাশি দেখতে পায়। সুলভ কমপ্লেক্সের সামনে অভিজিৎদা আর পিয়া দাঁড়িয়ে। বাঁদিকের লোকটা নেমে পঞ্চাশ টাকার নোট দিল। সবুজ কলারের নীচে ছোট পকেটের ড্রাইভার কিছুতেই খুচরো দেবে না। লেগে গেল ঝগড়া। রোজ এই ঝামেলা দেখতে দেখতে রাশির কিছুই আর যায় আসে না। ও ভাড়াটা দিতে ডান হাত বাড়াল। ওর বগলের নীচ দিয়ে একটা কুড়ি টাকার নোট এগিয়ে দিল ডানপাশে বসা লোকটা। রাশি হাতটা সরিয়ে নিল।
‘বাবু, আমারটা জলদি লিয়ে লাও। মেট্রো ধরব। শেয়ালদা যাব। লেড়কি আসছে, দামাদ আসছে।’
‘রামবিলাসদা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে? নেমন্তন্ন করলে না? কোথায় বিয়ে দিলে?’
‘সব জলদি হয়ে গেল ভাই। একদিন ভবানীপুরে আও দুকান মে ব্যায়ঠকে খানাপিনা হবে!’
‘আচ্ছা, যাব। উড়িয়াপাড়ায় ঝালাই করতে গেলে তোমার দোকানে ঘুরে আসব। কোথায় বিয়ে দিলে বললে না?’
‘আপনা জিলা ভাগলপুরে! আপনোকে ভিতর সে আচ্ছা রিস্তা আয়া। লেড়কা পি ডাব্লু কা ঠিকেদার হ্যায়। দেরি করতে চাইল না। বললাম, মাধ্যমিকটা দিক। বলে কিনা… লেড়কার দাদি বহুত বিমার। সাতদিন মে শাদি …আরে ক্যা করতানি হাম? আচ্ছা …চলি।’
এখনও রাশি অটোর সামনে দাঁড়িয়ে। ওর কুড়ি টাকার নোটের জন্য, পাঁচ টাকা ফেরত দিতে গিয়ে কয়েন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না, ড্রাইভারটা। খুচরো পয়সার ছোট থলে ঘাঁটতে ঘাঁটতে রাশির মুখ আর বুকের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে সে। রাশির মনে হয়, একবার কি জিজ্ঞাসা করবে? আপনার মা, বৌ …ওদেরও কি আপনার মত, আপনাদের মত মনখারাপ? ছেলেটা পাঁচটা ছোট এক টাকার কয়েন ফেরত দিয়ে বলল,
‘লেডিস বলেই রেজকি দিলাম। বাটা কত দিতে হয় জানেন?’
তারপর সামনে লাগানো মা-কালীর ছবি প্রণাম করে গাড়ি স্টার্ট দিল। হলদেটে হ্যালোজেন লাইটে ভেসে যাচ্ছে টালিগঞ্জের তিনরাস্তার মোড়। গাড়ির পাশাপাশি, মানুষের আসাযাওয়ার শেষ নেই। কেউ ফিরছে দিনের শেষে, কাজের শেষে, বাড়িতে আবার কেউ কাজে চলেছে। অকাজেও কি কেউ নেই? কিন্তু কোনগুলো অকাজ? সেদিন ওরা…ও, পিয়া, মহুয়া, ভাস্বতী, রিনিদি, বুচুপিসি ওরা সবাই যে বেরিয়ে এসেছিল রাত সাড়ে দশটায়। সেদিন কি ওরা অকাজে গেছিল? কী বলবে বুচুপিসি, ভাস্বতীদিরা? ওরা নিশ্চই বলবে… না, অকাজ কেন, এখনও পর্যন্ত বলবে, অন্তত রাশির তো তাই মনে হয়। কিন্তু ও, পিয়া আর মহুয়া? ওরা? ওদের এখন কী ভাবা উচিত? কাজ নাকি...
‘ঐ রাশি, রাশি…’
পিয়া দেখেছে ওকে। চিৎকার করে ডাকছে। অভিজিৎদাও হাতছানি দিচ্ছে।
***
অ্যায় মাঁঝলি বহু...মাঁঝলি বহু...মাঁঝলি বহু। শাশুড়ির রোজকার চিৎকার। অন্যদিন দোকানে যতই খদ্দের থাকুক, দেবিকা দৌড়ে চলে যায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে আজকাল হাঁটুর ভেতরে খচখচ করে। বাকি তিন ছেলের বৌ-এর রান্না শাশুড়ির পছন্দ না। জেঠজি আর ছোট দেবর ‘নকরি’ করে, আর সেজ দেবর মাসে কুড়ি-পঁচিশ দিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়, ট্র্যাভেল এজেন্টের ম্যানেজার। এমন সব স্বামীর জন্য তিনবৌ রান্না করে তাই নাকি ওদের এখনও রান্নার হাত খোলেনি! আর কবে খুলবে? ‘বচ্ছর’ কুড়ি তো হল! সব ঝামেলা দেবিকার ঘাড়ে। শুধু রান্না? দুটো হাঁটু এমন ক্ষয়েছে! বিছানায় বসেই খাওয়া, পায়খানা-পেচ্ছাপ। সব দেবিকাকেই করতে হয়। দুটোদিনের জন্য বাপের বাড়ি যেতে পারে না। বাবার টানের ‘বিমারি’ আসতে-যেতে হাঁপিয়ে পড়ে। তাও আসে! পিয়ার বাপকে শাশুড়ির দেখাশোনার জন্য একটা লোক রাখতে বললে এক জবাব,
‘মা-বাপ কি সেবা আপনি হাত সে করনে পর সোয়ারগ্ নসিব হোতে হ্যায়।’
দেবিকা, আর কথা বাড়ায় না। ও বুঝে গেছে কথা কাটাকাটি করে লাভ নেই। রাগ, দুঃখ সব গিলে ফেলে। সারাদিন এই ‘কিরানার’ দোকানে পাঁচমিশালি খদ্দের সামলাতে সত্যি বলতে বুঝতেও পারে না, কখন রাগ হয়েছিল! ঐ আবার বুড়িটা চেঁচাচ্ছে ‘…মাঁঝলি বহু…মাঁঝলি বহু…’
আজ যাবে না দেবিকা। মুতে ভিজে থাক, কিছুতেই যাবে না। জমে থাকা খদ্দেরগুলো চলে গেছে। এই ভর সন্ধেবেলায় একটা বাচ্চা সেলসম্যান…জামাকাপড় কাচার পাউডার কম্পানি, এসে জুটেছে। ছেলেটার কথা কানে ঢুকছে না দেবিকার। কী আর হবে হয় তিনবস্তা মাল নিলে, একবস্তা ফ্রি নাহয় তো টাকায় কুড়ি পয়সা কমিশান। লোকাল কম্পানি, টিভিতে অ্যাড নেই। ভাল খদ্দেররা এসব মাল নেয় না। তারা ধারের কার্ডে বাড়ি থেকে বা মলে গিয়ে মাল কেনে। ওদের দোকানে প্রায় সব মাসের খাতা। মাসের পয়সা পেতে দুমাস-তিনমাসও হয়ে যায়। আবার তিন-চারমাস বাকি খেয়ে, পাশের পাড়ার দোকান থেকে বাকি খাচ্ছে তেমনও কম নেই! দুপুরবেলা, বা রাত দশটার পরে বাড়িবাড়ি তাগাদা করতে যায় পিয়ার বাপ। লোকাল মাল রাখে দেবিকারা, চালিয়েও দেয়, খদ্দেরের না-নিয়েও উপায় থাকে না। বলতে গেলে খদ্দেরের মত, এই লোকাল কম্পানিরাও দেবিকাদের কাছে ‘লছমি’। ছেলেটার সাথে ভাল করে কথা বলে নেওয়া দরকার।
কিন্ত... পিয়াটার কী হবে? থানা থেকে ফোন করে বলেছে ছ-তারিখ, রাত সাড়ে-দশটায় যেতে। মেয়েটা তখন দোকানেই ছিল, হিসেবের ‘পরচি’ লিখছিল, পয়সা নিচ্ছিল। আগের দিন মার খেয়ে ওর সারা গায়ে ব্যাথা তবুও টুশানি করতে যাবে বলেছিল। দেবিকা যেতে দেয়নি। ফোনের কথাকটা শুনে মাথায় চক্কর দিচ্ছিল, দুই পায়ের পাতা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটা জানতে চাইছিল, দেবিকা ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিল। মুখ শুকিয়ে গেল মেয়ের, আগেরদিন মাঝরাতে ফিরেও অমন শুকোয়নি। দেবিকা একটাই কথা জিজ্ঞাসা করেছিল,
‘রাত সাড়ে দশটা?’
‘কেন? মাঝরাতে রোজ, রোজ গুল খিলাচ্ছে মেয়ে। আর এখানে ভয়? সিসিটিভি আছে!’
আশ্চর্যের আশ্চর্য তার একটু পরেই রাশির মুখটা ভেসে উঠেছিল। পিয়াকে যখন ডেকেছে, রাশিকেও ডাকবে, মহুয়াকে ডাকবে। মহুয়ার বাবা স্কুলে পড়ায়, বুঝতে পারছে, সব বুঝবেও। কিন্তু রাশির বাবা-মা? কয়েকদিন ধরে যা চলছে... ঐ যেদিন অমন মার খেয়ে এল, তারও তো আগে থেকে মেয়েরা দল করে এখানে-ওখানে যাচ্ছে, মিছিল করছে, রাত করে ফিরছে। ওরা চাইছে না রাশিটা যাক। মেয়েটা বাড়িতে মারও খেয়েছে। তবুও তো সেদিন বেরিয়েছিল। মারও খেল খুব! ওর ফোনটাও ভেঙে দিল। পিয়া বলেছিল, মারতে মারতে তিনচারটে ছেলে আর একটা গুন্ডা মহিলা,‘...চল খাল তুলব, খাল করে দেব চল...’
বলতে বলতে খালপাড়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল! হায় হায়! ইনসান অ্যায়সা কর সাকতা... ক্যা? সেই মেয়েটার বাড়িতেও তো এই ফোন যাবে! তারপরে জেরা! কী হালৎ চলছে মেয়েটার!
দেবিকা পরদিন খুব সকালে গিয়েছিল রাশিদের বাড়ি। রাশির বাবা, ছোট দুটো বোন ঘরের ভেতর ঘুমোচ্ছিল। ওর মা, কাঁদেনি,
‘কী হয়ে গেল দিদি! আমরা খাটাখাটনি করা লোক। আর তো ওর শাদি হবে না! দর্জির কাজ করে তিন তিনটে মেয়েকে পার করতে হচ্ছে। ওর আব্বা কী করবে বল?’
রাশি ‘ফাটাকসে’ বলে বসল,
‘আমি শাদি করব না!’
ঠাস করে একটা চড় মেরে বসল রাশির মা,
‘বাড়ি থেকে বেরোলে আমি কেটে ফেলব তোকে।’
‘আমি যাব… যা হবে যাবই।’
পিয়ার বাপও কি সব মানছে? মানবে? কিন্তু যো ভি হো…মেয়েটা উসকা, আঁখ কি তারা! শেষ পর্যন্ত…কিন্তু রাশি? হায় হায় ওরা তো কেউ জানে না, কোন কোন ধারা দিয়েছে? বাবাকে ফোন করেছিল দেবিকা। থানার একটা দালালকে চেনে বাবা, সেও সবটা এখনও ঠিকমত জানে না। বাবা, শুধু বলেছে বহুৎ বাজে কেস দিয়েছে বাচ্চা মেয়েগুলোর নামে! ক্যা বিচার হ্যায় ইস দেশ কা? মার খেল ওরা, আর ওরাই জেলে যাবে? তবু ভগবান আছে এখনও, তাই ধরে নিয়ে যায়নি। যেতে বলেছে। কিন্তু গেলেই যদি ধরে ফেলে?
‘…মাঁঝলি বহু…মাঁঝলি বহু!’
ওহ্, সেই চিৎকার, থামছেই না। আরে! সেলসম্যান ছেলেটা তো যায়নি এখনও। এর মধ্যে চার-পাঁচটা খদ্দের ছেড়েছে দেবিকা। ছেলেটাকে তো বলেও দিল, একবস্তা মাল দিতে। দাঁড়িয়ে আছে কেন? ছেলেটা ওর পেটের দিকে তাকিয়ে আছে না! হায় হায়, কাপড়টা সরে গিয়ে নাভিটা দেখা যাচ্ছে। ‘জনম কা মুসিব্বত’ সুযোগ পেলেই ওর নাভির দিকে বাচ্চা কি বুড়ো, ছেলেদের চোখ চলে যায়। পিয়ার বাপের তো, এই নাভিটাই… সামলে চলতে হয়। কিন্তু আজ বাটখারা ছুড়ে মারতে ইচ্ছা করছে, ছেলেটার চোখে।
…মাঁঝলি বহু…
আবার সেই বুড়ি? দেবিকা ঝাঁঝিয়ে উঠল,
‘আপনি দাঁড়িয়ে আছে কেন এখনও?’
‘না, মানে…অর্ডারটা ঠিক…’
‘অর্ডার? কোনো মাল লাগবে না। যাইয়ে, চলা যাইয়ে…!’
এবার যেতেই হবে উপরে। কী বলছে মহিলা, দেখা যাক। থাক দোকান খোলা।
‘আপ কিউ ইতনা চিল্লাতা হ্যায়? ক্যা হুয়া? কোই মর গ্যায়া ক্যা?’
‘মরনে ক্যা কুছ বাকি হ্যায় ক্যা?’
বুড়ি বেডপ্যান চাইল না। ঘড়িতে সাড়ে আটটা। রাতের খাবার সাড়ে নটায়। আটা মাখা আছে ফ্রিজে। নটায় রোজ রুটি করে দেবিকা। তাহলে? খাওয়ার সময়ও তো হয়নি?
‘আরে জনমজলি! লছমি বানাকে লে আয়ি থি। তু তো আভি জেল ভিজাগে ছোড়েগি সবকো…হে ভগবান! আপনি লেড়কি কো তো ছোড় দেতি! ক্যায়সি মা হ্যায় রে, তু?’
বুড়ির গলার স্বর নামছেই না। কী বলছে কী? মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি? পিয়ার বাপ মাঝরাতে গা ছুঁয়ে কথা দিয়েছিল, কাউকে বলবে না। লোকটার মাঝরাতে রোজ খিদে পায়। আজকাল, গায়ে-পায়ে ব্যাথা বলে দু-চারদিন ছিটকে সরে আসে সে। সেদিন রাতে নিজেই তো গেল দেবিকা। কথা আদায় করে নিল। তারপর? ‘মাই কা লাল’ ছেলেরা এমনই হয়! আরও তো তিনটে আছে, তারা তো এমন না! এদেরকে পাশে শুতে দিলে, এখনও ঠিক দুধ খেতে চাইবে! পেটে একটাও কথা থাকে না। আসুক…
‘ক্যা হুয়া, বোলতি বন্ধ হয়ে গেল, তুমহার, ডাইন?’
‘মুহ সামহালকে মা, এইসা আনাপশানাপ …কী বলছেন কী আপনি? পাগলা গ্যায়ি ক্যা?’
‘হাইয়, পাগলা হি গ্যায়ি হু রে! ই সব …দুকান, মুকান সব বেচ খায়েগি, পুলিস, বাকিল…হায় হায়!’
তার মানে সব জেনে গেছে। না, আর তর্ক করে লাভ নেই। দোকান খোলা। নীচে চলে যায় দেবিকা। কিন্তু কে বলল কথাটা? সত্যি কি পিয়ার বাপ? আচ্ছা সবাইকে জানিয়ে কী লাভ? আর খারাপ কিছু হলে তো এমনিতেই সবাই জেনে যাবে! এখনও তো সময় আছে! বাবা, তো বলল। ভাল উকিল দেখছে। খোঁজ দিয়েছে একজন। বাবা যে কারখানায় কাজ করত, তার ইউনিয়ান লিডার বলেছে, এই উকিল নাকি কেস হারে না! তার আগে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে তো! ঘরের মধ্যে এভাবে নিজেরা মাথা খারাপ করলে হবে? পিয়া কে, রাশিকে বাঁচাতে হবে না! পুলিশের লাল খাতায় ওদের নাম তো উঠতে দেওয়া যাবে না! আচ্ছা? সেই আবার রাশির নাম? কেন নিজের মেয়ের সাথে সাথে ওর নামটাও মনে চলে আসছে? রাশি কি ওর নিজের মেয়ে? পিয়ার বাপ বলছিল,
‘আপনি লেড়কি কে ঝামেলা হাম দেখে, রাশিকা মুসসিবত উসকা ঘরবালে দেখেঙ্গে, তুমহারি ইতনা চিন্তা কিউ হ্যায়…আর উ লোগ, আপনি বেরাদরি, বেরাদরি ক্যা, জাত…জাত তো ছোড়ো, উনলোগো কা কৌম হি আলাদা হ্যায়। তুমহে ইতনা চিন্তা কিঁউ হ্যায়?’
সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে পড়ে ও। দোকানে খদ্দের জমে গেছে। তাদের গলা শোনা যাচ্ছে। তবু থমকে দাঁড়িয়ে, দেবিকা নিজেকে জিজ্ঞাসা করে, আমি কি পিয়ার থেকেও রাশির কথা বেশি ভাবছি? উত্তর কিছুই পায় না। কিন্তু রাশির মুখটা আগে তারপর পিয়ার মুখ ওর বন্ধ দুচোখের সামনে ভেসে ওঠে। কেন এমন হচ্ছে? সত্যি কি, এই ঝামেলায় পড়ে ওদের ধর্মে, সমাজে মেয়েটার যদি বিয়ে শাদি নাহয়, সারাজীবন কুঁয়ারি থেকে যাবে, সেই ভয়েই কি দেবিকা হয়ত নিজের মেয়ের আগেই রাশির কথা ভেবে যাচ্ছে? এটা কি ঠিক করছে ও? কিন্তু এইসবকিছু, এত ঝামেলা…এসব কেন হল? …চটকা ভেঙে গেল পিয়ার বাপের গলার আওয়াজে, ‘তোমায় ভূতে ধরল নাকি? সিঁড়ি পর খাড়ে হো কিঁউ…ইধার আও।’
দেবিকা ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল, পিয়ার বাপ কি, তার মাকে সব জানিয়েছে? পিয়ার বাপ বেশ জোরেই বলল, ‘ক্যা করে! আদমি কো তো কিসি এক হোনা চাহিয়ে, যিসে ও, আপনি মন কি বাত কহে সাকে।’
তার মানে? কী বলছে লোকটা? না এখন আর কোনো উত্তর দেবে না ও। একজন আটা চেয়েছে, ও ভেতরের চিলতে গুদাম ঘরটায় চলে গেল ক্যারিব্যাগে আটা ভরতে। পিয়ার বাপের গলা শোনা যাচ্ছিল, ‘আরে দাদা, একটু দাঁড়ান না! বিমার মা, মেয়ে আর এই বউ নিয়ে ক্যায়সে ব্যবসা চালাচ্ছি…’
দেবিকার ফোনটা বাজছে। নটা, বাবা বলেছিল নটায় ফোন করবে। ফোনটা ক্যাশবাক্সর কাছে রাখা। পিয়ার বাবা বলে ওঠে,
‘তোমার ফুন…’
***
‘রুবি কাল, দুটো তেরোর ট্রেন। যেমন থাকি, কাউন্টারের সামনেই দাঁড়াব কিন্তু। তুই কটায় আসছিস? শেয়ালদায় জমায়েত সাড়ে তিনটেতে, অবশ্য তোকে কী বলছি? তুই তো আমাদেরই লিডার।’
‘শোনো…জমায়েত, টমায়েত, এইসব কথাগুলো বাদ দাও দেখি। এই ধরণের সব কথা, সাম্রাজ্যবাদ, লৌহশৃঙ্খল, কালো হাত… মানুষকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা কারুর গোলাম না! মেয়েদের ওপর এই যে টর্চার তার জাস্টিস বের করে আনতে হবে, বাই হুক অর ক্রুক!’
‘আচ্ছা, আচ্ছা। কী জানিস? আমি যেন কলেজের টাইমে চলে গেছি। সেই ইউনিয়ান, সেই ইউনিট, সেই আড্ডা, স্ট্রিট কর্ণার।’
‘তিরিশ বছর পেরিয়ে এসেছ। এখন আমাদের আর কোনো পলিটিক্স নেই। শুধু একটাই দাবী।’
‘আরে সেটাই তো চাইছি। তার জন্যেই তো এত কিছু! ঘর সংসার ফেলে, ছেলে-বরের যত্ন আত্তি ফেলে রোজ রোজ দৌড়োচ্ছি! ক্রিমিনালগুলোর পানিশমেন্ট দিতেই হবে।’
‘তোমার বরের কত বয়স হল গো দিদি? এখনও এত যত্ন? আর ছেলে? …মালটি-ন্যাশানালে কাজ করছে। তার বৌ থাকে হায়দ্রাবাদ। এবার একটু সেলফ-ডিপেন্ডেন্ট কর।’
‘আর বলিস না রে! এই ছেলেদের জাতটাই এমন! ঘরের কোনো কাজ নিজে করবে না। তবে খুব সাপোর্টিভ রে! আর তুই তো তোদের তপনদাকে চিরকাল চিনিস। এই যে যাচ্ছি, রাতের জমায়েতগুলোতে সেই বাইকে করে নিয়ে যায় দেখেছিস। এই যাঃ! আবার বলে ফেললাম, জমায়েত। রাগ করলি না তো?’
‘না…বল।’
‘সেই বাপ-ছেলে দুজনই বলছে চলে যাও, সুইগিতে অর্ডার দিয়ে দেব। দিচ্ছেও রে! কিন্তু রোজ রোজ এইসব গুষ্টির পিন্ডি গিললে, শরীর ঠিক থাকবে? আর, অর্ডার দিয়ে তো খেল! তারপর এঁটো থালাবাসন? ঘরদোর সব গোছানো? কাজের মেয়ে দিয়ে সবকিছু হয়? তার মধ্যেই রতনের মা, চলে গেল তার শ্বশুরবাড়ি, গোসাবায়! কীসব ঝামেলা হয়েছে গ্রামে? ওর ছোট মেয়েটা নাকি একদিন জিন্স-টপ পড়ে কলেজে গেছিল। তাতেই ষোল-আনা বসেছে। ষোল-আনা জানিস তো? ঐ যে মোড়ল-মাতব্বরের সালিশি! ...এই যাহ! ডাল বসিয়েছিলাম রে, পুড়ল বলে! টিভি দেখছিস? ঐ রত্নেশ্বর জোকারটাকে আজ যা চাটছে না সবাই মিলে! সে খালি বলে চলেছে…না, না, এইসব বিরোধীদের চক্রান্ত। আমরা তো চাই, মেয়েদের নজরের মধ্যে রাখতে। তাহলে কেউ কিছু করতে পারবে? আরে বাবা, সেইজন্যেই তো দেখেশুনে তবেই মেয়েদের যাতে রাতে কম বেরোতে হয়, তার পলিসি… এই যা ডালটা পুড়েই গেছে রে! তোদের তপনদা, পেঁয়াজ ফোড়ন দিয়ে মুসুরির ডাল নাহলে চলবে না…ইস!
‘আরে ডাল, ফাল থাকুক। শোন একটা ছোট ভিডিও পাঠাচ্ছি…’
রুবি আরো কয়েকবার চেষ্টা করল। রমাদি এনগেজড। শেষ কথাটা কি শুনেছে? ভিডিওটা তো পাঠাবেই রুবি। কিন্তু সে কি দেখবে? দেখবে না কেন? নিশ্চই দেখবে। সারা দেশের টিভিতে এত উথালপাতাল। গোটা শহরটা আর তার আশেপাশে যা হচ্ছে, যা চলছে…দেখলে বিশ্বাসই করা যাচ্ছে না! আমাদের ঘরের মেয়েদের, বাইরে কাজকরা মেয়েদের মনে এত সাহস ছিল? চিৎকার করে তারা কোন কথাগুলো বলছে? নির্মম একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তারা বলছে, একটা অতি সাধারণ মেয়ে বলে উঠছে,
‘আমার শরীর… আমার ইচ্ছের উলটো দিকে গিয়ে কেউ আমাকে…কোনভাবে…ছুঁতে পারবে না! কিচ্ছু করতে পারবে না! কোনো কাজ করাতে পারবে না!’
কেউ ভেবেছিল? নিজের পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে, মাইক লাগিয়ে… কোনো পার্টির ব্যানার না, কিচ্ছু না… মুখ নীচু করে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া চুড়িদার পরা বাড়ির বৌ, জিন্স-লেগিন্সের কলেজেপড়া মেয়ে, স্কার্ট-শার্ট পরা কর্পোরেট, বিপিওর চাকুরে… রাত দশটার পরে চিৎকার করে এইকথাগুলো বলবে কোনোদিন? মাঝ রাত, সারা রাত জুড়ে রাস্তায় হাঁটবে প্ল্যাকার্ড নিয়ে… সাহস থাকে, রেপ কর! হচ্ছে তো! রমাদিও তো সেই ডাকেই দৌড়ে যাচ্ছে রোজ। তাহলে দেখবে না কেন? কিন্তু তবুও চিরদিন রমাদির হাভভাব দেখে মনে হয়, একটা হুজুগে পাবলিক…
নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছা করে রুবির! রমাদি হুজুগে? তাহলে রোজ যে এত এত মেয়েরা, ঘরের কাজ সেরে, অফিস সেরে আর শুধু মেয়েরাই বা কেন, অগুনতি ছেলেরাও যে জুটে যাচ্ছে, সবাই হুজুগে? মানুষ কি চায় না! ...একটু সুস্থভাবে, হাসিমুখে বাঁচবে। তবুও যেন রুবির মনটা খচখচ করে। এত পতিভক্তি? এত ছেলের জন্য কেয়ার, স্নেহ? আচ্ছা, রুবি নিজেও কি ওর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ওর ভিক্টরকে প্যাম্পার করে না? প্যাম্পার? না, মোটেও না…এই যে, ভিক্টরের স্কুল আর টিউশনের ফাঁকে, যে কর্মসূচী পেয়েছে, ভিক্টরকে নিয়ে যায়নি রুবি? ছেলের শরীর দিচ্ছে না, ক্লান্ত, ঘুমিয়ে পড়ছে, তবুও তো সে, ভিক্টরকে নিয়ে গেছে রাত-দখলে, রাত দুটো পর্যন্ত জাগিয়ে রেখেছে। মাইকের সামনে ঠেলে দিয়েছে। কিছু বলুক, নিজের কথা। যদি সত্যি সম্মান করে তবেই না গলা খুলবে! জোর করে চিৎকার না করতে পারলে, কেউ তোর কথা শুনবে না। তোকে পাড়িয়ে চলে যাবে রে!
রমাদি যতই বলুক, ওর বরটাকে ভিড়ের মধ্যে একদিন দেখেনি রুবি। কলেজে পড়ার সময়েও মিছিল-ইউনিয়ান কিছুই করতে দেখেনি। অবশ্য কলেজেও পড়ত না লোকটা। দিনরাত সামনের পানের দোকানটায় আড্ডা। রায়পুর মোড়ের শীতলা হার্ডওয়ার ছিল ওদের ফ্যামিলি বিসনেস। তারপর প্রোমাটারি, কন্ট্রাকটারি, আরও কত কী! কলেজের ইউনিট সেক্রেটারি রমাদি সেখানেই ঝুলল! কে যে কোথায়, কীভাবে, কার সাথে ঝুলবে, এখন আর সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না রুবি। সেসব রহস্যের কোনো কিনারা হয় না! একটাই আনন্দের কথা, রমাদির ভেতরের জিনটা মরেনি… নাহলে রোজ রোজ অ্যাজিটেশানে যাওয়ার জন্য রুবিকে ফোন করে রমাদি। রুবি একদিনও ওকে ডাকেনি।
ফ্যাকাশে সবুজ নাইটি পরা, পৃথুল মহিলাটা। অল্পকটা চুল, ঝুঁটি খোঁপা। ডানহাতে একটা মোটা ডান্ডা। তেড়ে আসছে, প্রচন্ড হৈচৈ, মুখ খিস্তি, তারই মধ্যে কয়েকটা মেয়ের গলা একসাথে,
‘…উই ডিমান্ড জাস্টিস।’
চাপা পড়ে যাচ্ছে…ডিমান্ড জাস্টিস…সেই মহিলার কর্কশ কণ্ঠস্বর, ছাপিয়ে উঠল যত কোলাহল, ‘মাগি…খুব রাতে বেরোনোর শখ! চল… আজ ভেতরে ঢুকিয়ে দেব… কত বড় দেখেছিস?’
রাশির হালকা গলা শোনা যাচ্ছে, ‘আম্মা গো…বাঁচাও, বাঁচাও…’
ক্রিকেটের ব্যাট চালানোর মত মহিলা ডান্ডাটাকে চালালো, রাশির আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছে, ক্যামেরা নিশ্চই এরপর নীচের দিকে ঘুরে গেল, রাস্তার ব্লার ছবি। দ্রুত এঁকেবেঁকে সেই ছবিমালা চলছে। অসংখ্য উন্মত্ত পা-এর হুড়োহুড়ি বোঝা যাচ্ছে। অডিওতে শুধু মেয়েদের গলায় অসহায় আর্তনাদ, আর বিশ্রী কুৎসিত গালাগালি।
‘আমাদের দাদার পেছনে লেগেছিস? দেখ মাগিরা, জাস্টিস কীভাবে মারায়?’
ক্যামেরা রাস্তার দিক থেকে উঠে এসেছে উপরে। একটা রোগা-পাতলা মায়ের কোল থেকে, বাচ্চাকে ছিনিয়ে কয়েকটা লোমশ কালো হাত। বাচ্চাটাকে একটা ট্রাকের নীচে রাস্তায় শুইয়ে দিল। হৈচৈ পেরিয়ে কান চিরে দিয়ে আওয়াজ, ‘এই শান্তির ছেলে লরি…চালা, চালা, বাচ্চাটাকে লেবড়ে দে। নাহলে কিন্তু তোর ট্রাকের গাঢ় ফাটাব।’
নিশ্চই মাটার কান্না শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটা বিচ্ছিরি গলার স্বর, ‘অ্যাই, শিবে…বাচ্চাটাকে ছেড়ে দে, মাটাকে নীচে শোওয়া, গোপালিদি বলে দিয়েছে, বাচ্চাদের কিছু করা যাবে না। সেন্ট্রাল ঘুরে যাবে শালা…ছাড় বাচ্চাটাকে। অ্যাই…, অ্যাই মাগি, ভিডিও করছিস? শান্তি-সতী? দাঁড়া…’
শেষ হয়ে গেল ভিডিওটা। কাল পাঠিয়েছে রাশি। ওর ফোনটা তো নেই! নিশ্চই অনেক ঝক্কি পেরিয়ে পাঠিয়েছে। ফোনে কয়েকটামাত্র বাক্য শুধু বলল!
‘রুবিদি, এরপরে আমাদের নামে কেস করেছে। থানা থেকে ফোন করেছিল। কী কেস, কেমন কেস কিছুই জানি না! ভাল ল-ইয়ার পাওয়া যাবে? বেল না পাওয়া গেলে…’
তারপর একটা কান্নার ইমোজি। রাশিটার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল রুবির। গ্রুপ ছেড়ে দিয়েছে বছর দুয়েক। তাও পয়লা বৈশাখ, ফার্স্ট জানুয়ারি, বিজয়া, রুবির জন্মদিন হয় ফোন করে নাহয় মেসেজ। আর ফিফথ সেপ্টেম্বরে তো বাড়িতেই আসে গিফট নিয়ে। রুবি বারণ করে। গরীবের মেয়ে, সামান্য টিউশানির কটাই বা টাকা, তাতে চাকরির পরীক্ষার ট্রেনিং-এর খরচ! সংসারেও কিছু দেয়, মায়ের হাতে। কিন্তু রাশি বলে, ‘রুবিদি, তোমার থেকে অ্যাক্টিং শিখতে পারিনি তো কী হয়েছে, তুমিই আমার গুরু! আসল গুরু।’
কম কথা বলা মেয়ে রাশি, আর কিছু বলতে পারে না। রুবি ওর চোখ দেখে, বুঝতে পারে, সে রাশির কাছে আদর্শ! রুবি নিজের মনেই হেসে ওঠে, সে তো গ্রুপের ডিরেকটার না, মেন অ্যাক্ট্রেস না, আর গ্রুপের রেগুলার মেম্বারই না। গেস্ট আরটিস্ট। চার-পাঁচটা গ্রুপে ক্যারেকটারের প্রয়োজনে তাকে ডাকে। কখনও কখনও কিছু পয়সাও মেলে।
কীভাবে রাশি গ্রুপ থিয়েটারে এসে জুটেছিল সে খবর আজও রুবির কাছে নেই, বালুদা ডিরেক্টার বলেছিল, ‘রুবি, মেয়েটাকে বেসিকস একটু শিখিয়ে দিতে পারবে? আড়াই মাসে শো, এই বয়েসি মেয়ে আসছে না। আগে তাও সিরিয়ালের ট্রেনিং-এর জন্য আসত। এখন কোর্স করে সোজা স্টুডিওর সেটে।’
রাশির বাড়ি, রাশির সমাজ…সেসব ঠেলে রুবিদের জীবন বেছে নিতে পারবে মেয়েটা? এইসব ভাবনা ফিকে হয়ে গেল, মেয়েটা প্রথম শো-এর পরেই চলে গেল। বালুদা, কাকে যেন ফোন করেছিল, ‘আর যদি কাটাদের পাঠাস!’
সেই রাশিও ভেসে গেল প্রতিবাদের এই মহাপ্লাবনে? অনেকদিন পরে রুবির কান্না পেল। নাটকের চরিত্রে অভিনয়ের প্রয়োজনে জেলের ভেতরের কথা, থানার ভেতরের হাজতের কথা, তাকে আগাপাশতলা জানতে হয়েছে! একটা যুবতী মেয়ে সেখানে গেলে কী হয়ে উঠবে? হায় হায়… এই মাস দুয়েক রুবির সবকিছুই যেন পেছনে পড়ে গেছে। যখন যেখানে খবর পাচ্ছে, ঐ অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে…মিছিলে হোক, সমাবেশে হোক, কবিতায়, গানে , নাচে , মোমবাতি জ্বালিয়ে কিম্বা সারাটা রাতে দলবেঁধে আরও আরও মেয়েদের সাথে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে…রুবি যাচ্ছে। প্রথম সপ্তাহ দেড়েক সবাই যেন প্রতিবাদের পক্ষে ছিল। কিন্তু তারপরেই কাগজে, টিভিতে, সমাজ মাধ্যমে বিবৃতি প্রতিবাদীদের মাথাদের নামে শুরু হয়ে গেল আইনি প্রক্রিয়া… মামলা আর মামলার স্রোত শুরু হল। এবার… পাড়ার, ঘরের, পাশের বাড়ির মুখচোরা ছেলেমেয়েটাও যদি বেরিয়েছে বিচার চাইতে… ছাড়া পাবে না।
রুবি হাসে, হাসতে ভালবাসে। যত কষ্টই পাক না কেন, ও মন খারাপ করতে চায় না। কিন্তু আজ …এই রাত সাড়ে আটটা-নটার সময় বেরিয়ে শহরের একেবারে উল্টোদিকে রাশিদের পাড়ায়, না না পাড়ায় না, সেই বড় রাস্তার মোড় যেখানে রাশিরা মার খেয়েছে ঠিক সেইখানে গিয়ে একটা জোরদার সমাবেশ করতে ইচ্ছা করছে। স্লোগানে স্লোগানে ভূত-পেত্নীর দলকে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। সেটা হবে, হবেই… তার আগে, ভাল উকিল দরকার। তাই তো রমাদিকে ফোন করেছিল। ওর বরের বড় ব্যবসা। হাইকোর্টের একজন ভাল উকিলকে নাকি চেনে! রমাদি গল্প করে, সেই উকিলের ফ্যামিলির সাথে একসঙ্গে বারে-রেস্তোরাঁয় যায়, বেড়তে যায় ব্যাঙ্কক-পাটায়া। ঐ উকিলটাকে পেলে…কিন্তু হাইকোর্টের উকিলদের নাকি অনেক ফিস। যাদের নাম হয়েছে, কথা বলতেই তারা নাকি দশ-বিশ হাজার নেয়। তা হোক, রুবি দেবে, দরকারে কালেকশান করবে। আগে অর্গানাইজেশানের জন্য করত, এখনও তো গ্রুপের জন্য করে…না!
ফোন বাজছে। বেশ বেশ, সুদীপদার ফোন। সবার আগে ভিডিওটা সুদীপদাকেই পাঠিয়েছিল রুবি, ‘রুবি কথা বললাম সুপবনদার সঙ্গে। বলল, এসব নিয়ে একদম ভেব না। ভয় দেখাচ্ছে, ভয় পাবে না।’
‘বা রে! ছ তারিখে ডেকেছে, না গেলেই তো অ্যারেস্ট করবে। তখন?’
‘আরে তখন আর কী? ভাল করে ভেবে দেখ, আমরা থিয়েটারের লোক কী আর করতে পারি? তবুও সুপবনদা আমার কলেজবেলার সিনিয়ার, তাই টাইম দিল। অথরিটি সব থেকে ওকেই ভয় পায়।’
‘জানি তো সুদিপদা, তাই তো আপনার শরনাপন্ন হয়েছি।’
‘সে জানি বিউটিফুল! পবনদার কত সময় নষ্ট করে কথা বললাম। ওর এক এক মিনিটের কত দাম জান তো? বাদ দাও…একদিন অফিস ছুটির শেষে এস না! নতুন একটা স্ক্রিপ্ট এসেছে মাথায়! চায়না টাউনে চিনে খাবার খেয়েছ? সেদিন নাহয় বাড়িতে বলে রেখ।’
‘পবনদা, কী চলছে চতুর্দিকে, আর আপনি চাইনিজ? ...ওহ্!’
‘আরে যুদ্ধের সময়েও কি, মানুষের খাওয়া-দাওয়া, আরও যা বলে সেসব থেমে থাকে? ছাড়, যদি মেয়েটাকে কেউ বেল না করাতে পারে, তাহলে বোলো, তোমাকে নিয়ে যাব পবনদার কাছে। ও আবার সুন্দরী মেয়েদের রিকোয়েস্ট ফেলতে পারে না…রাগ কোরো না আবার। তোমরা তো ফেমিনিস্ট! জোকস অ্যাপার্ট…’
এবার ফোনটা রুবি নিজেই কেটে দিল। লোকটাকে এতদিন তো এমন লাগেনি। কারুর কাছেই কোনো অ্যাডভান্টেজ নেওয়া স্বভাব না ওর। আজ …একটা সুযোগেই… সুদীপদা?
ছিঃ ছিঃ। কিন্তু কী হবে রাশির? মেনকা এখনকার গ্রুপের একমাত্র মেনকাকে সন্ধেবেলায় ভিডিওটা দিয়েছিল রুবি। মেনকা বলেছে, ‘এসব যে দিনরাত হয়ে যাচ্ছে ভাই! কেউ মরেছে? ...না! ওখানে কারুর ধর্ষণ হয়েছে? ...না! তাহলে কী আর এল? গেল? আর যখন এতবড় একটা ঢেউ উঠছে মানে তোরা আন্দোলনে আন্দোলনে কাঁপিয়ে দিচ্ছিস, তখন তার ঝাপটা তো ছোটখাটো গাছে একটু লাগবেই…না! অত ভাবিস না! জল বাধা পেলে ঠিক রাস্তা খুঁজে নেয়!’
রুবি কি তাহলে আর ভাববে না রাশির জন্য? তাহলে তো…যে অন্যায়ের বিহিত চাইছে, আরও বড় কিছু ঘটে গেলে সেটাকেও ভুলে যেতে হয়! ...রাশি রে! আমার কথাই মনে পড়ল তোর?
***
চাঁদের অমাবস্যা, মাদার, আমার মেয়েবেলা, এ লাইফ ইন ওয়ার্ডস: মেমোরিস-ইসমত চুঘতাই…আরও কয়েকটা। খাটের পাশের ছোট্ট টেবিলে প্রিয় বইকটা রাখে বুলি। হাতে ফাঁকা সময় থাকলে, প্রিয় লাইন পড়তে থাকে। কিন্তু আজ, এই সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরেই খাটে এসে বসেছে। রোজ ছুটতে ছুটতে এসে আগে বুলবুলের ঘরে ঢোকে। আজ কে যেন টেনে এনে এখানে বসাল। এমনকি ওয়াশ রুমেও যেতে ইচ্ছে করল না। বইকটার ওপর হাত বোলাতে ইচ্ছা করছে বারবার। কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করছে না। বাবা বলত, বই পড়লে সব টেনশান দূর হয়ে যায়।
ও জোর করে ওয়ালিউল্লাহকে তুলে নেয় হাতে। নাহ… সারা শরীর জুড়ে কেমন যেন বিরক্তি আসছে। অফিস থেকে ফিরে এসে প্রায় রোজই সন্ধে-রাতে বেরোচ্ছে ও। অনেকের মত মোটেই মনে হয় না, ইতিহাসের চলমান স্রোত বয়ে চলেছে। ও শুধু অপেক্ষা করছে... আর একটু অপেক্ষা, আর একটু ধাক্কা, তারপরই মানুষের মনে দাউদাউ আগুন… এই নোংরা রাজনীতির শেষ হবে, ভোটের বুথে দাপাদাপি শেষ হবে। পুরোনো অভিজ্ঞতা আর ওদের মত নতুন রক্ত মেলানো একটা সিস্টেম আসছে, আসবে। তবেই তো মেয়েদের আসল মুক্তি! এখন তো এমন বিরক্তি লাগার সময় না! বাবা বেঁচে থাকলে বলত, ‘ভাল করে ভাব খুকি! এমন কিছু নিশ্চই শুনেছিস। না চাইতেও মনে দাগ কেটে গেছে রে!’
কী এমন শুনল বুলি? না, না…যা, যা চারিদিকে চলছে। এই চূড়ান্ত অ্যাজিটেশান। দুপক্ষের বিতন্ডা। সেসব তো সয়ে গেছে। যে আদেশ আসছে উপর থেকে, লোকাল নেতৃত্ব থেকে বুলি তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বাবার কাছে শুনত বুলি…বিপ্লবীরা, চূড়ান্ত অত্যাচার, অরাজকতা দেখলে খুশি হয়, জনগণকে পাশে পাওয়া যাবে, বদলে দেওয়া যাবে। এমন গনগনে আঁচে সেঁকছে নিজেকে বুলি, তার তো আনন্দে থাকার কথা? তবুও! …না, না, একটা হালকা বিরক্তি হচ্ছেই! সারাদিন, অফিসে, কী এমন ভাবল বুলি?
ওয়ালিউল্লাহ টেবিলে পড়ে রয়েছে। বুলি খোলা জানালার দিকে এগিয়ে গেল। শীতলামন্দিরের মোড়ে জটলা। এই মোড়ই এলাকার প্রথম ‘রাত দখল’! তবে সত্যি...একটা ইতিহাস কিন্তু তৈরি হয়েছিল সেইদিন। এই বোবা সমাজে, কেউ ভেবেছিল? ...আচ্ছা, আচ্ছা এবার মনে পড়েছে, সেই মেয়েকটার কথা, পুলিস কেস, তার মধ্যে মুসলিম মেয়েটা…কী যেন নাম? হ্যাঁ রাশি। যাওয়ার সময় সুমেধার থেকে শুনে…
আহ্… বুলবুলটা কাঁদছে, না? মা, কী করছে? মা… বুলবুল… আমার বুলবুল! তুই যে আমার জীবন, সোনা। আমি থাকতে তোর কিছু হবে না! দাঁড়া, যাচ্ছি রে বাবা। বুলি দৌড়ে যায় পাশের ঘরে। ততক্ষণে ওর মা…মা, ডাক; সারা বাড়ি জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। মা অবশ্য বুলবুলের পাশেই ছিল। বুলবুলের দুই কাঁধ ধরে খাটের সাথে চেপে রেখেছে মা…বুলবুল প্রচন্ড জোরে কাঁপছে, গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে ওর মুখ থেকে। মা ধরে রাখতে পারছে না। দিশেহারা বুলি বুলবুলের পাদুটো জোরে চেপে ধরে। ও তো কোনোদিন এমন করে না। নড়তে চড়তেই পারে না… চোদ্দোটা বছর খাটে পড়ে আছে। কথা বলতে পারে না। মুখের দুপাশ দিয়ে লালা ঝড়ে পরে সবসময়। কাউকেই চিনতে পারে না। অদ্ভূত, শুধু মা-এর দিকে তাকালেই ওর বোবা চোখদুটোয় একটা অলৌকিক ভাষা ফুটে ওঠে… বুলিকেও মনে হয় চেনে না… তবু বুলবুল তো বুলির, শুধুই বুলির।
‘ছেড়ে দে খুকি। থেমে গেছে। ছাড়…যা, গা-হাত-পা ধুয়ে নে। খেতে দিচ্ছি। আজ আর ঐ বুড়োগুলোর সাথে বেরোতে হবে না।’
বুলির মাথাটা গরম হয়ে গেল, ‘বুড়ো কাদের বলছ? বাবা, থাকলে ওরকমই দেখতে হত। চুল পেকে যেত, দাঁত পড়ে যেত।’
‘তোর সাথে ঝগড়া করতে পারছি না, তুই যা। তুই এসে পাশে বসলে। আমি উঠব। ডাক্তারবাবুকে ফোন করতে হবে। এমন তো এর আগে কোনদিন হয়নি!’
মা, হাঁপাচ্ছে। নয় ওয়াটের লেড ল্যাম্পের আলোয় মাকে যেন চিনতে পারে না বুলি। ঠিক যেন ছোটবেলায় পড়া বাচ্চাদের পত্রিকায় আঁকা কোনো বুড়ির পেন্সিল স্কেচ। মা, কবে এত বুড়ো হয়ে গেল? মায়া লাগল মাকে দেখে। এখনও এত কষ্ট করতে হচ্ছে! এই সংসারের সব কাজ, বুলবুলকে দেখাশোনা! কী করতে পারল বুলি, মার জন্য। ও উঠছে না দেখে মা, উঠে পড়ল। পাশের ঘরে গিয়ে নিশ্চই ডাইরি খুঁজছে। ঠিক এই সময় বুলির মনে হল, এখন আর কোনো বিরক্তি হচ্ছে না! অদ্ভূত যে! পাদুটো ছেড়ে বুলবুলকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে! কিন্তু আবার যদি হাসপাতাল হয়? কত নিয়ে নামবে? বাবার অ্যাকাউন্টে আর মেরেকেটে হাজার পনেরো। বুলবুলের পাদুটো ছেড়ে দেয় বুলি। দুচোখ বন্ধ করে রাখে। হাসপাতাল যদি হয়, তাহলে অফিস কদিন বন্ধ করতে হবে? সাতদিন হলে, পাচ হাজার ছশো... কাটা যাবে।
কসাই একেবারে, মালিক আর ম্যানেজার! না যেতে পারলেই মাইনে কাটা। বন্ডেড-লেবার বানিয়ে দিল? কিন্তু এই কাজটা না নিয়ে আর কী করতে পারত বুলি? মাসে পঁচিশ হাজার, সাথে মেডিকেল, চৌত্রিশ বছর বয়সে রিসেপশানিস্টের চাকরি! ইউনিভার্সিটির ব্যাচমেট শকুন্তলা ছেড়ে দিয়েছিল কাজটা। পরেশের খবরটা জানত শকুন্তলা। ওর সুপারিশেই গিয়েছিল বুলি। মালিক-ম্যানেজার ওকে দেখেই কেন নিয়ে নিয়েছিল, বুলি বোঝে। ওর ফিগার। কোনো অফিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ছিল না, একটাই ভার্বাল কন্ডিশান, মোটা হওয়া যাবে না। যে আদর্শের কথা বলত বাবা, তাকে অমান্য করে এমন একটা অপমানকর চাকরি! কী করতে পারত বুলি? পরেশ কোনো টাকাপয়সা দেয় না। কোর্ট-পুলিস? খরচ করতে পারলে আছে! বাবার যেটুকু ছিল, ঐসব করতে করতে চলে গেল! মাঝে মাঝে বুলির রাগ হয়, যদি আগের আমল থাকত, পরেশ কি এত সাহস দেখাত? থানাও চোখ বুজে থাকতে পারত? বুলি জানে বাবা এসবের মধ্যে কিছুতেই ঢুকত না। কিন্তু লোকাল থেকে কাউকে দিয়ে একটা ফোন করালেই পরেশ এসে পায়ে পড়ত। আর চাকরির জন্যেও কি এত নাকাল হত? বিয়ের আগে তুলসীকাকা বলেছিল, ‘এত ভাল রেজাল্ট, পি এইচ ডি করলি, চাকরি করবি না? বল না, কোথায় করবি? বাবাকে বলতে হবে না, আমাকে বল না একবার? বেশি টাকা মাইনে লাগবে? নিউ টাইমসের এডিটোরিয়াল বোর্ডে করবি? ফোন করব?’
পার্টি-অফিসের ল্যান্ডফোনের দিকে তুলসীকাকা হাত বাড়িয়েছিল। বুলি বাবার ভয়ে সাহস পায়নি।আজ হলে? মানত না বুলি। শুধু পরেশকেই বা কেন, এই মালিক-ম্যানেজার প্রত্যেককে শায়েস্তা করে দিত বুলি। একটু কি বেশি অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাচ্ছে না? যেমনই হোক, ঐ লোকদুটোর জন্যই পেটে ভাত পড়ছে। বুলবুল আর মায়ের ওষুধ আসছে বাড়িতে। সে তো, রাস্তার নেড়ি কুকুর বাড়ির সামনে শুয়ে থেকে সারা রাত পাহারা দেয় বলে লোকে উচ্ছিষ্ট ভাত-তরকারি তার মুখের সামনে ফেলে দেয়! তবে কি, নেড়ি কুকুরের মত ল্যাজ নেড়েই যেতে হবে? একবার ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না বুলি?
বুলবুল আবার একটু নড়ে উঠল, গায়ে হাত দিয়ে দেখল বুলি। গাটা বেশ গরম! তাহলে কি হাসপাতালেই? তবে তো কর্মসূচিগুলোতেও তো যাওয়া যাবে না। কী ভাবছে কী বুলি? ছেলে আগে, নাকি আগে পার্টির কল? বাবা কিন্তু ডাক শুনলে চলে যেত। জ্বর হয়ে বিছানায় পড়ে থেকেছে বুলি দিনের পর দিন আর বাবা কনফারেন্সে চলে গেছে জলপাইগুড়ি, দূর্গাপুর, গোপীবল্লভপুর। না, একটুও রাগ হত না বুলির। যেখানেই যেত বাবা সেখানকার ডেলিগেট ব্যাজ এনে ওর হাতে দিত। সব যত্ন করে রেখে দিয়েছে বুলি পুরোনো লোহার ট্রাঙ্কে, বাবার ব্যবহার করা কলম, চশমা, ছাতা, আর বই-পত্রিকার সাথে। সময় পেলে ট্রাঙ্ক খুলে সেসব দেখে বুলি, তবে সব থেকে বেশি দেখে ঐ ব্যাজগুলো। কিন্তু বুলবুলের কিছু হলে? ...ও কী করবে? এই যে পিক-পয়েন্টে উঠছে আন্দোলন, বুলি এখন কোথায় থাকবে? হাসপাতালে…
‘বুলি শোন, ডাক্তারবাবু বলল, মনে হচ্ছে সিজিন চেঞ্জের ভাইরাল জ্বর। যাদের হচ্ছে কাঁপুনি দিয়েই আসছে। প্যারাসিটামল দিতে বলল, তিনদিন। না কমলে, অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে… চিন্তা করিস না! যা… গা-হাত-পা ধুয়ে নে।’
বুলিরও মনে হয় জ্বর আসছে। গা-হাত-পা ব্যাথা করছে, মাথাটাও বেশ যন্ত্রণা করছে। বিছানায় শুয়েছিল ও। আর উঠে মশারি খাটাতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উঠতে হবেই। শহরে ডেঙ্গু এখন সারা বছর। ভোরের দিকে মশা কামড়ে দিলে, উপায় নেই। এখন অসুস্থ হলে চলবে? কিন্তু দেখ, এরিয়া অফিসে যারা বসেছিল, তাদের সবাইকে বুলি বলল, ‘উকিল-টুকিল পড়ে হবে। চলুন না, আমরা এখনই যাই। একটা সংখ্যালঘু পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর এই তো সুযোগ!’
কারুর যেন ইচ্ছাই নেই। টিভির দিকে চোখ। অবশ্য লিডার বলতে বাবুদা, অঞ্জু আর মিত্যুনকাকুদের মধ্যে কেউ ছিল না তখন। বুলি একবার ভাবল। নিজেই চলে যাবে। কিন্তু ওর ক্ষমতা কতটুকু? রাশি নামের মেয়েটার বাড়ি থেকে যদি বলে, একবার থানায় ফোন করুন তো! ও তো থানার কাউকে চেনেই না! আর চিনবেই বা কী করে? বাবা থাকলে, সেই আমল হলে বলে দেখত বুলি। পার্টির কোনো গরীব মানুষের কিছু হলে বাবাকে থানায় ফোন করতে দেখেছে বুলি। এইসব কাজকম্মের মধ্যে, মিছিল-মিটিং-এর মধ্যে যেন বাবা মিশে আছে, বাবাকে খুঁজতে থাকে বুলি। কেউ উঠছিল না দেখে সরাসরি রবীনকাকুকেই বলল বুলি, ‘চল কাকু, ঘুরেই আসি ওদের ওখান থেকে।’
‘না রে, বুলি…আমার জ্বর। আমি বাড়ি যামু।’
তার মানে রবীনকাকু অসুস্থ! দেখেছ? একটা জেনুইন কমরেডকে এখন, কদিন পাওয়া যাবে না।
‘কী করে জ্বর হল কাকু?’
‘আর কইস না ! ঠান্ডা লাইগা গেছে। ছোট শালি, আইছে জামশেদপুর থিকা। কইল-জামাইবাবু চলুন আইসক্রিম খাওয়াবেন। আর কী?’
তোমার না, টনসিলের দোষ আছে?
‘আর শালি হাত ধরে টান দিছে…তখন, টনসিল!’
‘এখন নাও জ্বরে ভোগো…তা এখানে কী করছ? বাড়ি গিয়ে আরাম কর!’
‘আরাম কী কস! তোর কাকি কইছে রুটি নিয়া আইবা। বাড়িতে অতিত আইছে না! তিরিশখান রুটি। রামবিলাসরে কইয়া আইছি, এতক্ষণে নিশ্চই হইয়া আইছে…যামু!’
বুলি অফিসের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। আজকের সন্ধেটা কোনো কাজে লাগানো গেল না! কয়েকদিনের মধ্যে কোনো কর্মসূচী নেই। একমাত্র সেই কেন্দ্রীয় অবস্থান চলছে তিরাশি দিন ধরে, সেখানে যাওয়া যেতে পারে। তাহলে তো অফিস বাদ দিতে হয়…তাহলেই মাইনেকাটার গল্প। রাতের বেলাতেই বা যায় কী করে? সারাটা দিন মা একা, বাজারঘাট বুলিকে রাতেই করতে হয়, ও ছাড়া করবেই বা কে? ওহ্…এইভাবে এক একটা মূল্যবান দিন বেকার চলে যাচ্ছে। মেয়েরা ক্ষেপে উঠছে চারিদিকে, এই তো সু্যোগ, মেয়েদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়ার। রোজ কিছু না কিছু তো করতেই হবে। পার্টি বুঝছে না কেন? আর কিছু না হোক, আমাদের দরদীদের বাড়িতে গিয়েও মেয়েদের সাথে কথা বলা যায় না?
পার্টি অফিসেই বুলির গাটা ম্যাজম্যাজ করতে শুরু করছিল। সাড়ে নটা নাগাদ অঞ্জু আর মিত্যুনকাকু একসাথে ঢুকল অফিসে। বুলি দেরি করেনি, সবার সামনেই আদ্যোপান্ত বলে রাশিদের বাড়ি যাওয়ার জন্য অঞ্জুর হাত ধরে টান দিতে যাচ্ছিল। মিত্যুনকাকু ততক্ষণে নিজের টেবিলের ওপারে নিজের চেয়ারে বসে পড়েছে। গম্ভীর গলার একটা বাক্য ছুঁড়ে থামাল বুলিকে, ‘রাশি মানে রাশিদা খাতুন। দর্জি সেখ সামাদের বড় মেয়ে তো?’
বুলি কোন উত্তর দিল না।
‘তুমি অল্প কয়েকদিন এসেছ বুলি। ঐ ফ্যামিলিটা আমাদের সমর্থক না। ইন-ফ্যাক্ট ঐ পাড়াটাও অনেকদিন ধরেই আমাদের ছেড়ে দিয়েছে।’
বাবার সাথী, বন্ধু মিত্যুনকাকু। বুলির বলতে ইচ্ছা করে অনেক কথা, তবুও চুপ করে থাকে।
‘ঐ কেসের দুটো ফ্যামিলি, আমাদের…দেখতে হবে ওদের!’
‘মেয়েটা কনস্টেবলের প্যানেলে উঠে বসে আছে। কেসে ফেসে গেলে ওর চাকরিটা হবে না যে!’
‘তোমাদের সব বিপ্লবী নেতারা, আগেকার কমিটির লিডাররা, কমরেডদের মাথার ওপর কতগুলো করে কেস রেখে গেছে জান? পার্টিকে সব মামলা উকিল দিয়ে লড়তে হয়! আর পুলিস তো শাসকের অস্ত্র, মেয়েটা কনস্টেবল হলে আমাদের কী কাজে লাগবে?’
বুলি বেরিয়ে এসেছিল তার মিনিট পাঁচেক পর। অঞ্জু এসে এসে কানে কানে বলল, ‘বাবুদার সাথে কথা বলছি রাতে। তুই রাগ করিস না। যা বাড়ি যা, কাল সকালে তো অফিস!’
এক পাড়ায় বাড়ি না হলেও, ও আর অঞ্জু দুজনেই এই ওয়ার্ডের মেয়ে। বিদ্যাবালা গার্লসে এক সেকশানেই দুজনে পড়েছে। কলেজ থেকে আলাদা। বুলির আশ্চর্য লাগে অঞ্জুদের বাড়ির কেউ কস্মিনকালেও পার্টিতে ছিল না, অথচ মেয়েটা ফুল টাইম পলিটিক্সে চলে এল! এখন পার্টি পাওয়ারে নেই, কিছুই পাওয়া যাবে না, তাহলে কেন? বিয়েটাও তো করল না। এই দুনিয়ায় অঞ্জুরাও আছে? আর দেখ, অঞ্জুরও কিছু বলার ক্ষমতা নেই কুটিল, বয়স্ক লোকটার মুখের ওপর।
মাঝরাতে বুলি মনে মনে বলল অঞ্জুকে, ‘রাশি নামের মেয়েটার সব থেকে বড় পরিচয়… সে একটা মেয়ে। তুই কি এটা মানিস অঞ্জু?’
দেওয়ালের কোথাও একটা টিকটিকি ডেকে উঠলে বুলি সাহস পাচ্ছিল আরও কথা বলতে। কিন্তু তার পরেই ওর মনে হল, ও নিজেও কি রাশি নামের মেয়েটাকে প্রথমেই মুসলিম ভেবে নেয়নি। বেল নিতে সাহায্য করার অছিলায় নিজেদের দিকে ওকে, ওর সম্প্রদায়কে ঘোরানোর কথা ভাবেনি ও? তাহলে? ...তাহলে কী দোষ মিত্যুনকাকুদের?
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
সঙ্গীতা কুন্ডু
1 মাস আগেবিগত কিছুদিনে সমাজে অনুভূত বাস্তব চিত্র। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম