preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
ব্যবচ্ছেদ: পর্ব ১১
ধারাবাহিক

ব্যবচ্ছেদ: পর্ব ১১

...আমার সাথে রোহিণীর দেখা হয়ে গেছে কোনো এক অজানা কারণে। আমি রোহিণীর দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছি, কেননা এক অপরাধবোধ কাজ করছে। এক অস্বস্তিকর পরিবেশ, যা আমাদের সবাইকেই এক কুয়াশার মাঝে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। জীবন যখন কোনো পথের নিশানা দিতে পারে না তখন হিসাব-নিকাশ করে বসে বসে। এটাই জগতের রীতি যার কাছে আমি বা রোহিণী দু-জনেই সমপরিমাণ লজ্জিত। তাই তো মনে হচ্ছে রোহিণীকে দেখে। সে কেন এমন মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।

এগারো

এক অবিশ্বাস্য সকাল মনে পড়ে। আয়নার সামনে দাঁড়াতে গিয়ে কেমন যেন নিজেকে কীর্ণ মনে পড়ে। মনে পড়ে এখানে যা কিছু আভ্যন্তরীণ তার বাইরেটা একেবারে অন্য। মুখোশের আড়ালে মুখোশ। অথচ সে-মুখোশ খুলে দিলে ব্যক্তিগত জীবন এতটা কুরূপ যে ভয় করে। তাই ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দেখি অমিয় স্যার কোনো এক ছাত্রীকে পটানোর চেষ্টা করছে। মেয়েটির মুখের কাছে মুখ এনে বোঝাচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।

বকুল পিসি তুমি কিছুক্ষণ বসে থাকো, এখনও সময় হয়নি। তোমার রিল্পেসমেন্ট পাওয়া গিয়েছে। তোমাকেই শেখাতে বলা হয়েছে। তুমি তাই এখন তোমার পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করছ। শ্রেণী সমন্বয়ের এ এক নতুন রূপ। সেকেন্ড লাইন তৈরি করা। কেননা থার্ড লাইন বেলাইন হয়ে অন্য দলে চলে যাচ্ছে। তুমি এদের পড়াতে গিয়ে ক্লান্ত। কেননা উদ্দেশ্য সমান্তরাল নয়।

আমি আর কলেজের সেই ছেলেটি যার কথা বলতে গিয়েও আটকে গেছে কথা। কেননা সব কিছু বলা যায় না। আমরা সেদিন সকালে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি পাশাপাশি। আমি যাচ্ছি কলেজ, সে যাচ্ছে সেই আমাদের কেমিস্ট্রি স্যারের বাড়ি। কীসব যেন ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। ট্রেনে দেখা হয়েছিল সেই ছেলেটার সাথে। না হলে একাই ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম আমিও একবার স্যারের বাড়ি যাব। অথচ একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছিল কোথাও। জানি সেই কিন্তুটা অবশ্য রোহিণী। তাও তার কথা যেন মনে রাখা বারণ। তাই তাকে বাদ দিয়ে অন্যকিছু ভাবতে হবে আমাকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকছি। আবার রোহিণীর কথা না ভাবার চেষ্টা করছি। ছেলেটি এসে কাঁধে হাত রাখল। কাঁধটা সরিয়ে নিলাম। তাকালাম তার দিকে। সে বলল, কোথায় যাচ্ছিস?

একটা অসমতা আর কিছু না। তুমি আমি বা আমরা সবাই সব সময় এই অসমতা নিয়েই চলতে ভালোবাসি। মানি বা না-মানি, রোহিণী হয়তো সেই অসমতাই বেছে নিয়েছিল। যা আমাকে জ্বালাচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। সেসব না দেখিয়ে দেখাচ্ছি কিছু একটা করে যাচ্ছি তাই সময় নেই। কিন্তু কী করছি তা জিজ্ঞাসা কোরো না যেন। উত্তর দেওয়ার মতো মন নেই। বা হয়তো উত্তর নেই। একটা এক্সক্লেমেটারি সাইন রয়েছে কোথাও। কিন্তু সেটা কোথায় তা জানা নেই।

বললাম, দেখি একবার কলেজ যাব। তারপর ভাবছি...
—স্যারর সাথে দেখা করব।
—কোথায় দেখা করবি?
—যেখানে দেখা হবে।

আমরা এখন হেঁটে যাচ্ছি, দু-জনেই চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছি। সকাল সাতটা কি সোয়া সাতটা হবে। ভোরের শহর কিছুটা ঘুমের কোলে ডুবে রয়েছে এখনও। ঘুমের আবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। রাস্তা এখানে এসে দু-দিকে ভাগ হয়ে গিয়েছে। ডান দিকে ঘুরে গেলে আমাদের কলেজ। সোজা গেলে রাস্তাটা আরও একটা বাজারের মাঝ দিয়ে চলে যায়। দু-পাশে মানুষের চলাচল, মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো নার্সিং হোম, তারপর মেডিসিন সপ। আর কোথাও কোথাও কিছু কিছু অন্ধকার বিন্দু। আমরা মহাজন টুলির ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। কেন আমি তো যাচ্ছিলাম কলেজ, তাহলে কলেজের দিকে কেন ঘুরে গেলাম না? এ-প্রশ্নটা থেকে যাবে গহনে। সোজা এই রাস্তাটা রোহিণীদের বাড়ি যায়। হ্যাঁ, এখন রোহিণীদের বাড়ি, আগে বলতাম কেমিস্ট্রি স্যারের বাড়ি। পাশে পাশে সেই ছেলেটাও স্যারের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে।

তারপর দেখা হল। দেখি স্যার সামনে থেকে হেঁটে আসছে। আমরা একেবারে মুখোমুখি। জীবনে যা কিছু আগে থেকে করব না ভেবেছি, দেখেছি কাজের সময় সেটাই করে বসেছি। বার বার ভেবেছি, না, এটা করা কখনোই উচিত হবে না। অথচ সেই অনুচিত কাজ করে মনে হয়েছে বেঁচে থাকা একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে নয়।

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

বন্ধুটি আমার দিকে তাকাল, আমিও তার দিকে তাকালাম।
বকুল পিসি তুমি এখনও বসে আছে। জানো না পার্টি থেকে প্রায় নির্বাসিত যারা, যারা এখনও অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকে তাদের জন্য এক নতুন এরিয়া বা জ়োন খোলা হয়েছে। যেভাবে ভোট দিতে গিয়ে যদি দেখা গেল ভোট আগে থেকেই পড়ে গিয়েছে, তখন প্রিসাইডিং অফিসার একটা এক্সট্রা ব্যালট পেপার দেয়, যাতে সেই ভোটার ভোট দিতে পারে। কিন্তু সেই পেপার আর ব্যালট বক্সে ফেলা হয় না। সাইডে রেখে দেওয়া হয়। সেভাবে আর কি তুমি এখন সেই জ়োনে পড়ে গেছ। যেখানে একবারে কিছু বলা বারণ। ধীরে ধীরে পর্দা খোলা হবে। একটু একটু করে দেখানো হবে বাসনাদি কেমন ভালো কাজ করে। যা কিছু তুমি পারোনি তা কত সহজে করে দিচ্ছে।

অমিয় স্যার বলতে গেলে আমি লজ্জিত তাই সরে এলাম দরজা থেকে। কি আর বলি। সব কিছু জলের মতো তরল অথচ বহমান নয়। সে রয়ে গেছে মজে যাওয়া ডোবা হয়ে। তাতে ভাসমান শ্যাওলা এই জীবনের মতো অপুষ্পক। মেয়েটি হয়তো এখন ক্লাস ইলেভেন বা টুয়েলভ। সদ্য উদ্ভিন্ন বুকের কুঁড়িতে কি তার লোলচর্ম হাত ভালো লাগবে? মনে মনে বলবে শুয়োরের বাচ্চা হারামি। কেননা সে এখনও কলেজ যায়নি তাই বেশি খিস্তি জানে না।

—কী চাইছেন স্যার?
—তোমাকে মাতৃভাব শেখাচ্ছি।

এদিকে দরজায় কে সে খবর কেউ জানে না। এক অন্তহীন প্রতিশোধ স্পৃহা, থেকে থেকে জানান দেয়। সে আছে ভিতরে। মিষ্টি ভালো করেছিস আজ আসিসনি। বাংলার স্যার এখন থেকে ব্যস্ত। তার কাছে আর হয়তো আসার কোনো প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু না আসলে মেয়েটির কী হবে?

তার জীবনের অভিজ্ঞতা বাড়বে। ভবিষ্যতে সে তার সঠিক জীবন সাথি খুঁজে পাবে নিশ্চিন্তে। যারা যারা প্রেমে পড়ে না তারা তারা আকাঙ্ক্ষায় ধোকা খায় বেশি। মেয়েটি শিখে যাবে।

কিন্তু এই প্রতিশোধ স্পৃহা, তার কী হবে? সে বকুল পিসির কোলে ঘুমিয়ে পড়বে। পিসি তাকে আঁচলে করে ঘরে নিয়ে যাবে। যেখানে তার ঠাকুরের আসন, যদিও সে কোনোদিন পুজো করেনি, তার স্বামী মাঝে মাঝে ধূপ দিত। সেখানে নামিয়ে রাখবে।

আমি আবার বন্ধুটির দিকে তাকাব। কিছু না-বলা কথা চোখর কোলে সেই স্পৃহাকে তৃপ্তি দিতে চলে আসবে। সামনে থেকে এগিয়ে আসছে রোহিণীর ভাতার। সামনে থেকে এগিয়ে আসছে এক স্বার্থপর মাস্টার যে শুধু নিজের স্টুডেন্টদের পাশ করায়। মাস্টার ঠিক যখন মুখোমুখি, সেই স্পৃহা খেলে যাবে আমার ভিতরে। কিন্তু কেন তার কোনো উত্তর করতে পারব না। বা যে-উত্তর আছে তা বিশ্বাস করতে পারব না কোনোদিন। সামনে কেউ না শুধু শুধু শুধু মাত্র রোহিণীর...

দে মার, দে মার, শালাকে ফেলে মার। উবুড় করে মার। চিত করে মার। মন কিন্তু বলছে এটা করা উচিত নয়, অথচ আমার হাত জোড়া। কী করি?

শেষ মুহূর্তে সে চিত হয়ে পড়েছিল। আমাদের যেন হয়ে গেছে। আমরা উঠে পড়লাম। অথচ আবার কেন জানি না দাঁড়ালাম। কিছু হিসাব শেষ হওয়ার পরেও শেষ হয় না। আরেকটা লাথি মারলাম তার দু-পায়ের মাঝে। হয়তো রোহিণীর কথা ভেবে বা তার বাবার কথা ভেবে, জানি না।

তবে এখন এই ঘর আর এতগুলো মানুষের মাঝে বসে আছি। সব ছবি এক নতুন মাত্রা নিয়ে চলে আসছে সামনে। বাবা আবার কখন কে জানে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবং সেই আপ সাইড ডাউন। দেখতে পাচ্ছি মাথা নীচে, না না মাথা নীচে কেন, মাথা উপরেই। শুধু আমার ভিউ পয়েন্ট আলাদা। মনে হচ্ছে বাবা উপর থেকে পড়ে যাচ্ছে নীচে। আমার কানের কাছে বলছে, এত দৌড়াস না। এত কেন ছুটছিস? কীসের ভয়? আমি বলছি, তুমি কেন ছুটছ? বাবা বলছে, আমি অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, এত ছুটতে হয় না।

—তবে ভয় নয়, অথচ কেন যে সেদিন মাস্টারমশাইকে মেরেছিলাম, তার মিথ্যা কোনো কারণ খুঁজে নিজেকে লজ্জিত আর করতে চাইনি। ছুটতে শুরু করেছি। আর কোনোদিনও কলেজে ফিরে যাইনি। পড়া শেষ করে বসে থেকেছি অনেকদিন। যেন আমাকে সবাই তাড়া করছে। আমি পালাচ্ছি। কেন আমি সেদিন তেমন কাজ করেছিলাম?
—সেই বন্ধুটির কী হল তারপর?
—জানা নেই। তার সাথে আর কোনোদিন দেখা হয়নি। সে-ও ছুটছিল আমার পাশাপাশি।
—আর রোহিণী, আর মিষ্টি।
—ওদের সাথেও দেখা করিনি। ওরাই যেন এক-একটা প্রশ্ন।

বাবা বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছে। বাবার চোখে জল। আজ প্রথমবার দেখলাম বাবার চোখে জল। কেন? বাবা সেই যে সাধকের নাম করেছিলাম, সেই হরিপুর লাইনের এক গ্রামের মানুষ, তাকে নিয়ে এসেছে। সে আবার দাঁড়িয়ে থাকে। বসে না। তার জীবনের বা সাধনের একটাই প্রতিজ্ঞা, সে বসবে না। দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু ঘুমোনোর সময়? জিজ্ঞাসা করতে মন আর চায়নি। এমনিতেই এত সমস্যা তার উপর আবার এইসব প্রশ্ন। তবে আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারি বাবা কেন তার কাছে গিয়েছিল। বাসনাদিকে কি মনে পড়ছে, বাবা? বকুল পিসির পরের প্রজন্ম।

—হ্যাঁ বাসনা, আমি তার কাছেই গিয়েছি। সে এখন এখানে থাকে না। তার ছেলে আছে।
—কিন্তু তাকে আর কী দরকার? তার কাছ থেকে যা নেওয়ার তো নিয়ে নেওয়া হয়েছে।
—সেটাই তো, সে যদি ফিরে আসতে চায়?
—সে আর ফিরতে পারবে না। সব কিছু গুছিয়ে চলে গেছে এখান থেকে।
—অথচ সেদিন দেখলাম বকুলদি যখন তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে, পিছন থেকে আবছা মতো একা অবয়ব ছিল। বাসনার মতো দেখতে। মুখ দেখিনি কিন্তু শরীরটা দেখেই চিনেছি। এত চেনা দেহ কি কেউ ভুলতে পারে?
—সে কি কিছু চাইছিল?
—না সে কিছু চায়নি, কিন্তু আমি দেখলাম বকুলদি আর বুকু হেঁটমুণ্ড ছিল। কিন্তু বাসনা ছিল আমার সমান। অথচ তারা তো সবাই আগের যুগের মানুষজন। তাহলে বাসনা কেন হেঁটমুণ্ড হল না।
—কারণ তুমি আর বাসনা মাসি একই ডাইমেনশনে আছ। বা আমরা সবাই একই ডাইমেনশনে রয়েছি।
—তাহলে নিখিল?

হ্যাঁ এখন নিখিল আর বুকুদা ভাগ হয়ে গিয়েছে। এক নিখিল নিয়ে এসেছে আরেক নিখিলকে। দুটো নিখিল এখন নিজেদের চরিত্র পালটাতে ব্যস্ত। তার মাঝে কিছুক্ষণ নাহয় সেই সাধকের সাথে কথা বলি। সাধক তুমি কি বলতে পারবে একজন মানুষ কিভাবে দু-ভাগে ভাগ হতে পারে?
—একজন মানুষ কোথায়? কার কথা জানতে চাইছ?
—ওই যে বুকুদা, যার সাথে কত খেলেছি সেদিনও। তখন তো সে ড্রিবল করে এমনভাবে বেরোত যেন কোনো অজেয় রাজকুমার যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে।
—সে বুকু কিন্তু এখন আর বুকু নেই। যেদিন খেলা ছেড়েছিল সেদিনই নিখিল হয়ে গিয়েছে।
—সে আমি জানি, যেদিন তার বাবা মারা গেল, শ্মশান থেকে সে ফিরেছিল একা। আমরা সাথে ছিলাম, কিন্তু সে একাই ছিল। আর একমাত্র আমাদের মতো মাঠের কিছু ছেলে ছিল। মায়ের এতদিনের কর্মজগৎ, কিন্তু সেখান থেকে কেউ ছিল না। নিখিল তাকিয়ে ছিল পিছনে। আমরা পিছন থেকে দেখেছিলাম তার চোখ জ্বলছে। ঘরে যখন ফিরে গেল দরজা বন্ধ করে দিল। বাইরে দু-একজন তখন পার্টির মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ সে আর দরজা খোলেনি। বাসনা মাসি বাবাকে বলে ছিল একবার দেখা করতে। বাবা গেছিল কি না জানি না।
—তোমার বাবা যেতে ভয় পেয়েছিল।
—ভয় কীসের?
—যেভাবে তুমি সেদিন ভয় পেয়ে পালিয়েছিলে। আর কোনোদিন রোহিণীর সাথে দেখা করতে পারোনি। সেভাবে তোমার বাবাও ভয় পেয়েছিল।
—রোহিণী কিন্তু কোনো পুলিশ কেস করেনি।
—তোমার মাও তো কাউকে জানতে দেয়নি, যে সে সব জানে।
—তাহলে সেদিন আমাদের পালিয়ে যাওয়ার পর মাস্টারের কী হয়েছিল?
—তার যৌনাঙ্গে আঘাত লেগেছিল খুব।
—তারপর?
—তারপর আমি জানি না। তুমি রোহিণীকে জিজ্ঞাসা করে নিও।
এখন আমি কথায় কথায় দেখছি, সেই সাধক কখন কে জানে আমার সমতলে ফিরে এসেছে। এখন আর সে আপ সাইড ডাউন নয়। মুখোমুখি বসে কথা বলছে। তাই প্রশ্নের চোখ নিয়ে তাকালাম? সে বলল
—আমাকে যে যেমন চায়, তার সাথে তেমনভাবেই দেখা করি। এতক্ষণ তোমার বাবার সাথে ছিলাম, এখন তোমার সাথে আছি।
—এটাই কি জীবনের রীতি? যে যেমন চায় তার সাথে তেমনভাবে দেখা করা?
—না জীবনের রীতি হল সব সময় নিজের মতোই থাকা, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তার কিছুটা তফাত হয়। এখন কেন সেই তফাত তা জানতে চেয়ো না।
—অথচ আমার সেই প্রশ্নটার তো কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।
—কেন মানুষ দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়? কেননা প্রকৃতি জগতকে স্বার্থপরভাবে তৈরি করেছে। হিংসা বা লোভ সহজাত। শিশুর কান্না যেমন সহজাত। যখন শিশু হাসতে শিখছে তখন তার মাথা কাজ করছে। হাসি সহজাত নয়, কান্না সহজাত।
—তাহলে?
—তাহলে তোমার মা একদিন যেমন কিছু সোনার গয়না মাথার পাশে রেখে শুয়েছিল। তোমার বাবা ঘরে আসেনি।
—আর রোহিণী?

এখানে একটা পজ় পড়ে গেল অজান্তে। কেউ যেন আমাদের টেনে নিয়ে গেল কোনো এক সন্ধ্যার পেটের ভিতর। যেখানে আমার সাথে রোহিণীর দেখা হয়ে গেছে কোনো এক অজানা কারণে। আমি রোহিণীর দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছি, কেননা এক অপরাধবোধ কাজ করছে। এক অস্বস্তিকর পরিবেশ, যা আমাদের সবাইকেই এক কুয়াশার মাঝে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। জীবন যখন কোনো পথের নিশানা দিতে পারে না তখন হিসাব-নিকাশ করে বসে বসে। এটাই জগতের রীতি যার কাছে আমি বা রোহিণী দু-জনেই সমপরিমাণ লজ্জিত। তাই তো মনে হচ্ছে রোহিণীকে দেখে। সে কেন এমন মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি না হয় তার বরকে... কিন্তু সে তো তারপর কিছু একটা স্টেপ নিতে পারত। সেদিনের সেই শহর, যা চিরকাল ঘাঁটি ছিল তখনকার রুলিং পার্টির। তার স্বামীর ঘর ছিল অলিখিত পার্টি অফিস। পুরো ফ্যামিলিটাই পলিটিক্সে ছিল। তাহলে?

অনেক অনেক প্রতীক্ষা, আমি আর রোহিণী স্থির, কিন্তু কেন? কী চাইছি আমরা। দেখলাম অমিয় স্যার আসছেন। তাকে কি ডাকা হয়েছে? বা খবর পেয়েছে কিছু একটা কারণে। জানা নেই। এলেন অথচ আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন না। পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন কিছুটা তফাতে। আমি জানি তিনিও আজ লজ্জিত। মেয়ের মুখের দিকে তাকানোর মতো সাহস নেই। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন যেন কিছু একটা আমি করি। তার মেয়ে এখান থেকে যেন চলে যায়। বাইরের মানুষ আর ভিতরের মানুষ যখন আলাদা হয়ে যায় তখন সব পবিত্র পাপী ডুব দেয় জলে। অথচ জল তাকে সামান্য নিঃশ্বাসও দেয় না। সে তো আর কোনো যোগী সাধক নয় যে সাধন পথে নিঃশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করবে। সে সামান্য মানুষ, লোভী আর নাই বা বললাম। অমিয় স্যার কেন এলেন আপনি?

এখন আমরা তিনজন তিন দিকে তাকিয়ে রয়েছি। কখন কে জানে আমাদের মাঝে নিখিল এসে দাঁড়িয়েছে। তাকালাম বা না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম, বুকুদা। তুমি আবার কেন? না কি এখন পরিবর্তিত নিখিল এসেছে সামনে, যে বিপ্লবের সাথে কিছু এক আঁতাত করবে? বুকুদা সেই মাঠ কি মনে নেই। যেখানে একদিন খেলার মাঝে আমাদের মাথায় থাপ্পড় মেরে বলতে সঠিক সময় বল পাশ করলি না কেন? মাঠ বড়ো কর, মাঠ বড়ো কর। বেশি জায়গা নিয়ে খেল।

বুকুদা ইশারায় বলল, না আমি নিজে আসিনি, আমি একটা খবর এনেছি ব্যাস। মিষ্টির খবর। সে কেমন আছে জানতে চাস না?

মিষ্টি, ও বাবা সে এখনও বেঁচে আছে? একদিন তার মা আমাকে ফোনে বলেছিল তার মেয়ে খুব বাচ্চা, তার কথা যেন আমি না ধরি। আমি কিছু একটা কারণে ফোন করেছিলাম মিষ্টির কাছে। তখন কলেজের শেষ দিক। মন খুব অস্থির। কলেজ যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। সেটাই বলার ছিল। দু-তিনবার ফোন করার পরে তার মা বলল এই। সত্যি কিছু মনে করিনি। তার তো খুব ভালো থাকার কথা।

একটা পজ় আর এতগুলো মানুষের আনাগোনা তার মাঝে। কতটুকু সময় হবে। কয়েক সেকেন্ড ব্যাস কিন্তু আয়না বড়োই বেইমান। মিথ্যে দেখাতে পারে না। মনে হল আমার সামনের সেই সাধক জীবনের আয়না। তাকে খুব অপ্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন করলাম এখানে, রোহিণীর বাচ্চা হয়েছিল?


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

দেবনাথ সুকান্ত একজন লৌহ ইস্পাত কারখানার শ্রমিক এবং সেই শ্রমিকের চোখ দিয়েই দেখতে চান তাঁর কাঙ্ক্ষিত পৃথিবী, যা উঠে আসে তাঁর যাপিত জীবনের কবিতা এবং গল্প উপন্যাসে। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রেরা তাঁর গহন মনের ভিতর রেখে যায় ইস্পাতের মতো দৃঢ় চেতনার সমন্বয়। তার কিছুটা তিনি লেখেন, কিছুটা জমিয়ে রাখেন কালের প্রবাহের জন্য। এর আগে লিখেছেন, ‘ছেদবিন্দু', ‘টানেলের মুখে কিছু হায়ারোগ্লিফ’, ‘এক অপরিহার্য রক্তরেখায়’, ‘অন্ধকারে এক জলস্রোত’-এর মত কাব্যগ্রন্থ, ‘রক্তাক্ত স্পর্শের আলো’-এর মত উপন্যাস। যা আসলে তার অতীতকে খুঁজে নিজেরই মুখ বার করার এক প্রয়াস। তার বেড়ে ওঠা দুর্গাপুরে। চাকরি সূত্রে ঘুরেছেন, হাজারিবাগ, বোকারো, ধানবাদ, রাঁচি আর বার্নপুর। ভালোবাসেন বই পড়তে আর বাঁশি বাজাতে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন