দশ
রোহিণীর পৃথিবীটা ঘুরে গেছে। ও এখন আর আমাদের মতো নেই। মিষ্টির মা বলেছিল, মেয়েরা কিন্তু এত সহজে পালটে যায় না বাবা। কিন্তু আমি জানি মেয়েরাই পালটে যায়। ছেলেরা বেচারা দেখতে থাকে কেমিস্ট্রিবাবু বার বার ভিতরে যাচ্ছে আর আসছে। যতবার বেরিয়ে আসছে ততবার তার চুল-টুল আঁচড়ে আসছে। শালা কী করছে ভিতরে?
আমরা তিনজন এখন দেখছি হঠাৎ করে যেন আমাদের সামনে সব কিছু উলটে গেল। ফ্র্যাকশন অফ সেকেন্ডে দেখলাম জানালা দিয়ে যেন মাটি রাস্তাঘাট মানুষজন সব উপরে উঠে গেল। আর আকাশটা ঘুরে নীচে নেমে এল। পুরো পৃথিবীটাই ঘুরে গেল আমাদের সামনে।
বাবা ছুটে ছুটতে ঘরে এল যেন পাগল একজন। বলল বাবা, জানিস বকুলদি আর বুকু। হ্যাঁ তাই তো দেখলাম হেঁটমুণ্ড আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞাসা করল সব কিছু চলছে কেমন। বললাম ভালোই। বলল আমি তো আমার পৃথিবীতে পারলাম না, কিন্তু আমার এই ছেলেটা কি তোমার পৃথিবীতে সেট হবে।
বাবা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল, আর আমি বাবার চোখের দিকে। আমি বুঝতে পারলাম বাবা কিছু একটা বোঝাতে চাইছে, যা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। যদিও আমি বুঝেও না বোঝার মতো কিছু একটা করতে চাইছিলাম। বাবা বলল, কিরে কিছু বুঝতে পারছিস?
আমরা তিন জন তিন দিকে তাকিয়ে রয়েছি এখন। বাবা আমার দিকে, বাবা আমার দিকে। বিপ্লবদা আর কার্তিক কিন্তু এখনও জানালার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। তারা আমাকে ডাকল।
বিপ্লবদা বলল, কার্তিক কী দেখছিস এখন?
কার্তিক বলল, দাদা আকাশটা কেমন যেন নীচে নেমে এসেছে।
—আর মাটি?
—মাটি উপরে।
—আমরা কি বেঁচে আছি?
—সেটাই তো মনে হয়।
—তাহলে এই ভরদুপুরে কি নেশা করে এসেছি?
—আমি তো করিনি, তুমি নিজেরটা দেখো।
—আর তুই?
বিপ্লবদা আমার দিকে তাকাল। আমি আবার জানালার দিকে তাকালাম। না, এবার তো সব ঠিকই লাগছে। বললাম, কই, কী বলছ?
ভ্রূ কুঁচকে বিপ্লবদা বলল, কী আবার, জানালা দিয়ে দেখ। আমি জানালা দিয়ে তাকালাম আবার। ইশারায় বললাম কী?
ওরা দু-জন জানালা দিয়ে দেখতে থাকল। এদিকে আবার বেল বাজল দরজায়। ঘুরে দেখলাম বাবা নেই। আরে বাবা তো এখনই ছিল। কোথায় গেল? তাহলে কি বাবা আসেনি? কিন্তু...
—আরে বুকুদা তুমি। আর সাথে ইনি কে?
বুকুদা বলল, এঁর নাম নিখিল।
—নিখিল, সে তো তোমার নাম।
—কেন এক নাম কি একজনের মাত্র থাকবে? আর কারোর হতে পারে না?
—ও আচ্ছা, তা হবে না কেন?
—নিখিল বিপ্লবের সাথে দেখা করতে এসেছে।
বিপ্লবদা ফিরে এল বসার ঘরে। আমি তাদের বসার জন্য জায়গা করে দিলাম। ওরা বসল মুখোমুখি। কিন্তু বাবা গেল কোথায়? এই তো এসেছিল। আমার সাথে কথা বলে গেল।
একটা সময়কাল পেরিয়ে অন্য একটা সময়কালে আসতে পারলে, সব অতীত ভবিষ্যৎ আর সব ভবিষ্যৎ কি অতীত হয়ে যায়? নিখিলকে দেখে তাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বিপ্লবদা তার সামনে বসে আছে কিছু একটা আর্জি নিয়ে। আর সে একভাবে দেখে যাচ্ছে বিপ্লবদাকে। উপরে ফ্যান ঘুরে যাচ্ছে যেন উলটো দিকে। মানে ফ্যানের কোনো হাওয়া তাদের মাথায় এসে পড়ছে না। মাথাটা গরম হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কিন্তু এ-মাথাগরম অন্যরকম। এখানে রাগারাগি নয়। মাথা ঘুরানো। মাথা ঘুরে যাওয়ার সামিল। এবং তার সংক্রমণ সর্বগ্রাসী। আমি দেখছি। আমি শুনছি। আমি অনুভব করছি। এখানে সময় যেন বিপরীত দিকে চলতে শুরু করেছে। যদিও তার কোনো সারমর্ম খুঁজে বার করতে পারছি না।
তাহলে কি বাবা এদের সবাইকে এইজন্যই পাঠিয়েছে। কিন্তু বাবা নিজে গেল কোথায়? এসেও চলে গেল এমনভাবে যেন আসেইনি। আমি ঘরের ভিতরে চলে এলাম। ডেকে নিলাম কার্তিককে। ওখানে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। কার্তিক বলল, ওই লোকটা কে? যে বুকুদার সাথে এসেছে।
—সে আরেক নিখিল।
—একটা নিখিল দিয়ে কি হচ্ছিল না?
—কে জানে ভাই? বার বার নিখিলই কেন চলে আসছে?
জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে বাবার সাথে তাদের দেখা হয়েছে কি না। কিন্তু না, এখন কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে না। এখন তারা একে অন্যকে দেখে যাচ্ছে। বুকুদা যেন মধ্যস্থতা করতে এসেছে এখানে। বসার ঘর থেকে আমাকে ডেকে বলছে, একটা পেন খাতা দিয়ে যা। কিছু হিসাব বাকি আছে।
—বুকুদা বাবার সাথে কি তোমার দেখা হয়েছিল।
—হ্যাঁ, তোর বাবাকে দেখলাম বছর পনেরো পরে। অনেক পালটে গিয়েছে। এখন আর সেই দাদাটি নেই আমার। আমার সাথের প্রথম কলকাতা গিয়েছিল। কিন্তু আর তাকে ফিরে আসতে হয়নি।
—ফিরে আসতে হয়নি মানে?
—মানে কি তুই বুঝিস না?
—না মানে বলছিলাম যে বাবা কবে তোমার সাথে কলকাতায় গেল?
—সে তোর জন্মের আগে। সেখানেই তোর মার সাথে দেখা। আমিই পরিচয় করিয়ে দি।
—ও আচ্ছা।
—বউদি ঘরে নেই।
বুকুদা ঘরের এদিক-ওদিক দেখতে থাকল। বলল বাঃ ভালো ভালো। খুব সুন্দর হয়েছে তোদের ঘর। আগে কোথায় থাকতিস, সেই কোম্পানির কোয়ার্টার। ছোটো ছোটো ঘর। এখন আর তেমন নয়।
—বুকুদা, বলছি যে, বকুল পিসি কি তোমার সাথে ছিল একটু আগে।
—মা? হ্যাঁ ছিল তো। কেন বলতো?
—না কিছু না। এই লোকটা কে?
—এ কেউ নয়, ধরে রাখ আমিই এসেছি।
—তাহলে তুমি সোজাভাবে কেন আছ? তোমার পৃথিবীটা উলটে যাচ্ছে না কেন?
কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’।
সব প্রশ্নের উত্তর নেই। সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তাই কিছু কিছু প্রশ্ন নিজেই একটা উত্তর হয়ে থেকে যায় মানুষের মাঝে। মানুষ তার উত্তর না খুঁজে প্রশ্নের কারণ খুঁজতে চায়। যদিও কিছুই পায় না। আমার চারপাশের চরিত্রগুলো তেমনই আমাকে প্রশ্ন করে। আমি সে-প্রশ্নের কারণ খুঁজে বেড়াই। মিষ্টি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, দুম করে আমার মাকে এমন প্রণাম করার কি ছিল তোর?
মিষ্টি আবার তুই-তে ফিরে এসেছে। আমি তাই বলি, কেন প্রণাম করতে নেই? তোর মা। তোর তো ভালো লাগা উচিত।
—ভালো লাগাটা যদি বাড়তে থাকে তখন?
—তখন নাহয় আবার তুমি করে ডাকবি?
—তাহলে রোহিণীর কী হবে?
—আর রোহিণী।
আমি সেদিন মিষ্টিকে একটা মিথ্যে কথা বলেছিলাম। তার মা আমাকে ডেকেছিল। সেটা জানাইনি। তার মারই বারণ ছিল। উনি আসলে রোহিণীর কথাই জানতে চেয়েছিলেন। রোহিণী কে? আমাদের সাথে তার কেমন পরিচয়? আর সেই তার কেমিস্ট্রির মাস্টার মশাই। উনি কেমন?
বলেছিলাম রোহিণীর পৃথিবীটা ঘুরে গেছে। ও এখন আর আমাদের মতো নেই। মিষ্টির মা বলেছিল, মেয়েরা কিন্তু এত সহজে পালটে যায় না বাবা। কিন্তু আমি জানি মেয়েরাই পালটে যায়। ছেলেরা বেচারা দেখতে থাকে কেমিস্ট্রিবাবু বার বার ভিতরে যাচ্ছে আর আসছে। যতবার বেরিয়ে আসছে ততবার তার চুল-টুল আঁচড়ে আসছে। শালা কী করছে ভিতরে? রোহিণী খেলা করছে তার সোনাটাকে নিয়ে। ব্যাচের ছেলেগুলো ফিকফিক করে হাসছে আর মেয়েগুলো পেন দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে একে অন্যকে। আমি যেন ভিতরে ভিতরে জ্বলে যাচ্ছি। আর বুঝতে পারছি মিষ্টি খেয়াল করছে আমাকে। মিষ্টি শুধু দেখে যাচ্ছে আমি কী করি। সে আমার ছায়ায় পরিণত হয়েছে। আমি আমার ছায়া থেকে পালাতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু অমিয় স্যার?
আমরা অমিয় স্যারের ঘর থেকে তখন ফিরছিলাম। অমিয় স্যার কিছু কাজ দিয়ে উঠে গেছিলেন। আমরা বসে বসে এক সময় উঠে গেলাম। নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে মিষ্টিকে বললাম, চপ খাবি? মিষ্টি কিছু না বলে শুধু তাকাল একবার। মনে হল সব কিছু বলা হয়ে গেছে তার, এখন এক অপেক্ষা। সেই প্রথম এবং শেষ বার তাকে কিছু খাওয়াতে চেয়েছিলাম। যদিও পকেটে পয়সা সংকুলান, তাও সামান্য যেটুকু ছিল তা যেন সাত রাজার ধন হিরে মাণিক।
সেদিনই শেষ, তারপর আর কোনোদিনও মিষ্টির সাথে দেখা হয়নি। বা বলতে গেলে আমিই দেখা করিনি। কলেজ শেষ হয়ে গেল, বা শেষ করে দিলাম একদিন। কেন শেষ করলাম তা বলার মতো কোনো জায়গা থাকল না। অনেকদিন পরে একটা ফোন এল। দিনের বেলায় বার কয়েক ফোন এসেছিল। মা বলেছিল, কেউ তোকে খুঁজছে। আমি তুললে কথা বলছে না। ভেবেছিলাম নির্ঘাত মিষ্টি হবে। কিন্তু না, রোহিণী ফোন করেছে! এবং জানতে চাইছে মিষ্টি কেমন আছে? আমি অবাক।
তাহলে এখন, এখন কি আবার সেই অবাক হওয়ার পালা চলছে। বুকুদা একটু বেশি এগ্রেসিভ হয়ে গিয়েছে। তাকিয়ে আছে ঠিক যেন তার অপনেন্ট। মাঝ মাঠে বল। তাকে ড্রিবল করে নিয়ে যেতে হবে। যেতে গিয়ে কেউ তাকে পিছন থেকে ট্যকেল করবে। সে পুস করবে সোলডার দিয়ে। সে পড়ে যেতে যেতেও ধরে ফেলবে নিখিলের জার্সি। বুকুদা সেই নিখিলকে রেখে নিজের পজিশন পালটে নেবে। ঠিক আপ সাইড ডাউন। বুকুদার খেলার মাঠ উলটে গেছে। নিখিল এখন বিপ্লবের মুখোমুখি। এক নিখিল নিয়ে এসেছে আরেক নিখিলকে। দেখছি এটাই যেন স্বাভাবিক। আমার নিখিল উলটে যাচ্ছে, আমরাও মুখোমুখি।
দেখছি দরজায় কেউ এল। নিখিল জানাল বেল বাজছে। বললাম, খুলে দাও। বুকুদা উঠে গিয়ে খুলে দিল দরজা। দরজা দিয়ে বাবা এগিয়ে এল সম্মুখে। বাবার মাথা নীচের দিকে। বাবা, তুমি তাহলে আমাদের না ওদের?
কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই,ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন।
এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
মন্তব্য করুন