preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ৯
ধারাবাহিক

চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ৯

খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে চোখটা লেগে আসে একসময়।
কিন্তু দুম করে সেই বীভৎস দৃশ্যটার ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ দারোগার মাথার ভিতর। সচকিত হয়ে ওঠেন তিনি।
বিস্ফারিত দুই চোখ আকাশের দিকে মেলে চিত হয়ে পড়ে আছেন বিশ্বামিত্র। সাথে সাথে দিবানিদ্রা সম্পূর্ণ কেটে যায় মাহাতোর। ভাবনাগুলো মাথার ভিতর ফের খামচাতে আরম্ভ করে। এইটা কী করে হয়! পিছন থেকে গুলি করলে একজন মানুষের উপুড় হয়ে পড়ার কথা। উনি চিত হয়ে পড়েছিলেন কেন! তাহলে কি আততায়ী মৃত্যুর পরে দেহটা চিত করে দিয়েছিল এবং তখনই সরিয়ে নিয়েছিল মোবাইল ফোনটা!

পঁচিশ

সোনারি। ঝাড়খণ্ড।

অলকানন্দার মতে, প্রভুর যুক্তিহীন এবং অন্ধ ভাবাবেগ হিন্দু সমাজকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেয়নি। এই হেন মহাপ্রভুকে নিয়ে ওই নাক উঁচু ছেলেটার কী এত পড়াশুনা! কৌতূহল বাড়তে থাকে।

কথা হচ্ছিল, কী করে ক্যান্টিনে প্রথম আলাপ অলকানন্দা এবং স্বপ্ননীলের। সেদিন চা খাওয়া হয়ে গেলে, নীলের বন্ধুরা উঠে চলে যায় যে যার মত। ওই দিকে, অলকানন্দার টেবিলে যারা ছিল তারাও একসময় ফিরে যায় নন্দাকে রেখে। তবে এটাও হতে পারে, নন্দা আড়চোখে দেখে নিয়েছিল নীলকে এবং কোনও একটা কিছু আঁচ করেই সে আর ওঠেনি।

অনাবশ্যক মানুষজন ফিরে যাওয়ার পরও দু’এক মুহূর্ত বসে থাকতে হয় স্বপ্ননীলকে, নিজেকে চূড়ান্ত ভাবে প্রস্তুত করে নেওয়ার জন্য। এরপর এগিয়ে যায়। অলকার সামনে চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে, “কিছু দিন ধরে লাইব্রেরিতে দেখছি না তো আপনাকে?”

বেশ ভালো একটা ‘বল’ বাড়ায় স্বপ্ননীল। এফোর্ডলেস অথচ এফেকটিভ। বাক্য শুনলে কে বলবে যে এটাই ওদের প্রথম আলাপচারিতা! তবে অলকানন্দাও বুনো তেঁতুল, “বাব্বা আপনি আবার কবে আমায় দেখলেন চোখ তুলে। চৈতন্য মহাপ্রভুতেই তো বিলীন হয়ে থাকেন দেখি!”

স্বপ্ননীল বলে, “চা দিতে বলি...”

“হুমম বলতে পারেন। মাথাটা বেশ ধরেছে।”

“ইতিহাস পড়া মাথা তো...একটু আধটু ধরে। একটা কড়া লিকার খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

“হ্যাঁ ঠিক। আমার জন্য লিকার...উইথ সুগার...”

এরপর নারী সুলভ রহস্য মাখানো ভঙ্গিমা, “ফার্মাসিস্টদের বুঝি মাথা ধরে না... দে হ্যাভ নো হেডেক...”

ভালো করে তাকায় নীল অলকানন্দার দিকে। ক্যান্টিনময় ওড়া প্রজাপতির দল এবার তার হাতের মুঠোয়। মৃদু হাসতে হাসতে বলে, “মাথা থাকলেই ব্যথা থাকবে। তবে তারা ওষুধটা জানে।”

নীলের কথা শেষ হবার আগেই নন্দা বলে, “আচ্ছা... ফার্মাকোলজি নিয়ে যাদের পড়াশুনো তারা কি ভগবান শ্রী কৃষ্ণের অনুগামী...আর দে ফলোয়ার অফ লর্ড শ্রীকৃষ্ণ?”

বংশপরম্পরায়, হিন্দুত্বের এবং উচ্চ বংশের অভিমান লালিত পালিত হয়েছে অলকানন্দার মধ্যে। ধর্ম নিয়ে তারও কিছু পড়াশুনা আছে। মহাপ্রভু কী করেছেন? না পবিত্র ধর্মটাকে নষ্ট করেছেন! বেদ উপনিষদে যা বলা হয়েছে তা ভেঙে চুরমার করে দিতে চেয়েছেন বারে বারে। বর্ণাশ্রমকে উড়িয়ে দিয়েছেন নিজের মত করে। মহামান্য শঙ্করাচার্যকে পর্যন্ত অস্বীকার করেছেন। নিজের প্রভাব খাটিয়ে রাজা প্রতাপরুদ্রকে বশ করেছেন। ওঁর প্রভাবে রাজা প্রজা একই ঘাটে জল খেয়েছে একসময়। মহাপ্রভু সম্পর্কে কথা বলতে গেলেই তার বাক্য কিঞ্চিৎ তির্যক হয়ে যায়।

ওই দিকে, অলকার কথায় কিঞ্চিৎ খেই হারিয়ে ফেলে নীল। তবে সপ্রতিভ ভাব বজায় থাকে। হাল্কা করে একটাই শব্দ বাতাসে ভাসায়, “পার্ডন…”

“না এমনিই বললাম...আসলে...”

বাক্য শেষ হবার আগেই উঠে যায় স্বপ্ননীল। দুটো চা নিয়ে ফিরে আসে, “এই নিন...”

“আপনি আবার দুম করে উঠে গেলেন কেন? বললে এখানেই দিয়ে যেত।”

“ইটজ ওকে … আপনি কি যেন একটা বলছিলেন...। লর্ড শ্রীকৃষ্ণ না কী যেন একটা…”

ওই বিষয় নিয়ে আর কথা বাড়ায় না নন্দা। স্বপ্ননীল টি-ব্যাগটা দু’আঙুল দিয়ে কাপের মধ্যে নাচায়। অলকানন্দা অন্য কথা বলে, “আচ্ছা 'আপনি'টা একটু বোকা বোকা শোনাচ্ছে না?”

এই কথা বলতে বলতেই ব্যাগ থেকে একটা হেয়ার ক্লিপ বার করেছিল নন্দা। দুটো হাত পিছনে নিয়ে আলতো করে ধরেছিল কেশরাশি। খাড়া ভাবে লাগিয়ে দিয়েছিল ক্লিপ। দুই অহংকারী বুক আরও সুন্দর দেখিয়েছিল ঐ সময়। নীলের চোখের সামনে তখন একটা রেসিং গ্রাউন্ড। সবুজের বুক চিরে ছুটে গিয়েছিল দুটো টাট্টু ঘোড়া।

এরপর, লাইব্রেরি-ক্যাম্পাস-ক্যান্টিন-ওপেন এয়ার থিয়েটার। মেঘের উপর পা ঝুলিয়ে বসে দিন কাটতে থাকে ভালই। অবশ্য সরাসরি প্রেম নিবেদন করা হয়ে ওঠে নি কোনোদিক থেকেই। আজও।

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

ছাব্বিশ

ফুলওয়ারিতোড়। ঝাড়খণ্ড।

ফুলওয়ারিতোড় হাইওয়েতে অরবিন্দ প্রতিহারী এবং অনন্ত মহাষুর। যাচ্ছে আবদুলদের গ্রাম গাজি-বটতলার দিকে। একটা ভয়ংকর কাজের দায়িত্ব তাদের কাঁধে।

পূর্বনির্ধারিত জায়গায় এসে দাঁড়ায় ইনোভা। হাইওয়ের ধারেই ফুলওয়ারিতোড় পেট্রোল পাম্প। নেমে আসে প্রতিহারী এবং মহাষুর। এখান থেকে সাইকেল ভ্যানে যেতে হবে ওদের। বিশেষ কারণে এই রকম ব্যবস্থা। গাঁয়ের মেঠো পথে ওই ঝাঁ চকচকে গাড়ি চোখে লাগতে পারে। শুরু হয়ে যেতে পারে নজরদারি।

ওরা যে প্রথম এখানে আসছে তা নয়। তাও একটা সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কোনও বারই চকমকি যানবাহন নিয়ে গাঁয়ে ঢোকেনি প্রতিহারীরা। সালাউদ্দিনের লোকজন মোটর বাইক অথবা সাইকেল ভ্যানে করে নিয়ে গেছে ফুলওয়াড়িতোর থেকে।

অরবিন্দরা নামার পর ড্রাইভারও নেমে আসেন ইনোভা থেকে। পাম্পের এক কোণায় ওদের জন্য নির্দিষ্ট ত্রিচক্র যানটি অপেক্ষারত। ভ্যান চালককে কী যেন বলেন ড্রাইভার সাহেব। সংক্ষিপ্ত বাক্যালাপ শেষে ইশারায় ডাকেন অনন্তদের। ভ্যানে উঠে বসে মহাষুর এবং প্রতিহারী।

পেট্রোল পাম্প থেকে বেরিয়েই হাইওয়ে। এই রাস্তা ধরে বেশ খানিক যাবার পর পাওয়া যাবে গাঁয়ের মেঠো পথ। সূর্যের আলোয় অস্তাচলের ইশারা। চারপাশে এখন এক অদ্ভুত কাটাকুটি খেলা, আলো আর নৈঃশব্দ্যের। ডিভাইডারে ছোটো ছোটো গাছ। পাতায় তাদের ঝিরঝিরে হাওয়া।

প্যাডেল চাপা নয় মোটর লাগানো ভ্যান। এগিয়ে যায় সাঁই সাঁই। যে গতিতে চলছে সেটা ভ্যানের ওজন এবং চেহারার সাথে মানানসই নয়। কাজেই, থরথর করে কাঁপছে। হাইওয়ে বলে কথা, জেট-গতিতে ছুটে যাচ্ছে দশ-বারো চাকার গাড়ি। ত্রিচক্রর মাথাখানা কাঁপতে কাঁপতে একবার ডানপাশে গোত্তা খেলে আর দেখতে হবে না।

ডানদিকে বসেছিলেন অরবিন্দ প্রতিহারী। চালকের সিটের তলা থেকে গোল গোল দুটো আংটা মত বেরিয়ে। সেটা ছাড়া ধরার আর কিছু নেই। অরবিন্দ ওটাকেই যতটা পারা যায় আঁকড়ে ধরেন। চোখের ইশারায় অনন্তকেও বলেন চেপে ধরতে। বাধ্য ছেলের মত তাই করে অনন্ত।

মানুষের চরিত্র বড় অদ্ভুত। যে অনন্ত মহাষুরের মানুষ খুন করতে বিন্দুমাত্র হাত কাঁপে না সে নিজের বেলায় কত সাবধানী!

মিনিট আট-দশ ঐ রকম চলার পর ‘সাধু’ বটের নীচে বৈগা-পাড়ার মোড়ল রকেট মুর্মুর চায়ের দোকান দেখতে পাওয়া যায়। বটের শাখা প্রশাখার এত ঘনঘটা যে তলায় প্রায় অন্ধকার নেমে গেছে এর মধ্যেই। দোকানের সামনে ছোটো এক-ফালি দাওয়া। ঝুলে আছে সস্তা এল ই ডি বাতি। এখনও ফিকে। অন্ধকার যত বাড়বে তত বাড়বে আলোকচ্ছটা।

গোটা দুয়েক কাঠের বেঞ্চ পাতা। জনা চারেক হাটুরে লোক। নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। আগে সবাই একসাথে বসে মৌজ করত এইখানে। কে হিন্দু, কে মুসলিম, এই নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না কারও। রতন–আবদুল, সব একসাথে বসত কাঁধ ঘষাঘষি করে। কিন্তু হনুমান মন্দিরে দাঙ্গার পর পরিস্থিতি পাল্টেছে।

তবে বৈগা পাড়ার মোড়োল, রকেটের সাথে সবার ভাব ভালবাসা এখনও অটুট। সে সব শোনে আর অন্দরে ভরে রাখে। দরকার হলে কাজে লাগায় সেই তথ্য। অর্থাৎ খবর চালাচালি করে ইধার-উধার।

অরবিন্দরা একটা বেঞ্চে এসে বসে। লোকজন গল্প থামিয়ে ওদের দিকে তাকায়। দু’এক মুহূর্ত বাদেই আবার ডুবে যায় নিজেদের মধ্যে।

অনন্তর চেহারা বেশ বড়সড় কিন্তু সেইরকম চেহারার মানুষ গ্রামে গঞ্জে দেখা যায় না তা নয়। মোদ্দা কথা, অরবিন্দ কিংবা অনন্তর চেহারার মধ্যে আলাদা কোনও চাকচিক্য নেই। এটা তাঁদের কাছে সুবিধার। বাইরের লোকজনের সাথে চট করে মিশে যেতে কোনও সমস্যা হয় না।

অনন্তর ইচ্ছে ছিল না এখানে বসে চা খাওয়ার। এক, তার কোনোরকম নেশাভানের ব্যাপার নেই । দুই, যার তার সাথে যেখানে খুশি বসতে সে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু অরবিন্দ জনপ্রতিনিধি। হোটেল পদ্মনাভ থেকে দড়মার দোকান, সবেতেই স্বচ্ছন্দ এবং সাবলীল।

ভ্যান চালক ছেলেটিও এসেছিল পিছন পিছন। চা খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে মাথা নেড়ে সায় দেয়। অরবিন্দ তিনটে চায়ের অর্ডার দেয়।

হাটুরে কথোপকথনের আওয়াজ খানিক কমলেও, ভালো করে কান পাতলে বোঝা যায় বিষয়বস্তু। নতুন কিছু নয়। চন্দ্রপুরা এবং তার আশেপাশে যে ‘রায়ট’ চলছে, সেটা নিয়েই ঝড় বইছে। প্রতিহারী জানেন চায়ের দোকান হল এরকম জায়গা যেখান থেকে এলাকার হাল হকিকত সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। সালাউদ্দিনের গ্রামে ঢোকার আগে ‘পালস’টা বুঝে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রতিহারী কোনও কাজ এমনি করেন না। আপাতভাবে যা উদ্দেশ্যহীন তার মধ্যেও লুক্কায়িত থাকে কোনও গূঢ় সংকেত।

আলোচনা শুনে বুঝতে পারা যায়, যে পলতেটা পাকানো হচ্ছে অনেকদিন ধরে তাতে অগ্নিসংযোগ হয়ে গেছে। এখন শুধু সাধ্যমত হাওয়া দিয়ে যেতে হবে। ব্যাস তাহলেই কেল্লা ফতে।

একটা নিষ্ঠুর অথচ নির্লিপ্ত হাসি খেলে যায় অরবিন্দর ঠোঁটে।

সাতাশ

চন্দ্রপুরা থানা । ঝাড়খণ্ড।

দুপুরবেলা নিজের কোয়ার্টারে গিয়েছিলেন সুজয় মাহাতো। খাওয়া দাওয়া সেরে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসেন। খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে চোখটা লেগে আসে একসময়।

কিন্তু দুম করে সেই বীভৎস দৃশ্যটার ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ মাথার ভিতর। সচকিত হয়ে ওঠেন। বিস্ফারিত দুই চোখ আকাশের দিকে মেলে চিত হয়ে পড়ে আছেন বিশ্বামিত্র। সাথে সাথে দিবানিদ্রা সম্পূর্ণ কেটে যায় মাহাতোর। ভাবনাগুলো মাথার ভিতর ফের খামচাতে আরম্ভ করে। এইটা কী করে হয় ! পিছন থেকে গুলি করলে একজন মানুষের উপুড় হয়ে পড়ার কথা। উনি চিত হয়ে পড়েছিলেন কেন ! তাহলে কি আততায়ী মৃত্যুর পরে দেহটা চিত করে দিয়েছিল এবং তখনই সরিয়ে নিয়েছিল মোবাইল ফোনটা !

এইদিকে, আততায়ীয় হাতের ছাপ আলাদা করে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। কারণ মন্দিরের সিকুরিটি গার্ড বিশ্বামিত্রকে চিত হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তাঁর মাথাটা কোলে তুলে নিয়েছিল। সিকুরিটি বলবন্তের স্পর্শের ভিড়ে আততায়ীর হাতের ছাপ হারিয়ে যাওয়ার কথা। না, কোনোদিকেই কোনও সুরাহা হচ্ছে না তদন্তের। চিন্তা করতে করতে মাহাতো টান টান উঠে বসেন চেয়ারে। কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলের একপাশে রেখে দেন।

গবাক্ষপথে উঁকি দিচ্ছে প্রাক সন্ধ্যার ইশারা। আলোক রেখায় ধূলিকণার আনাগোনা। একটা দিন শেষ হতে চলল কিন্তু এখনও অব্দি কোনও কূলকিনারা পাওয়া যায়নি। একটা ছটফটানি নিয়ে উঠে দাঁড়ান মাহাতো। একবার ভাবেন রহস্যময় নীল ডাইরিটা নিয়ে বসবেন, যেটা পাওয়া গেছে বিশ্বামিত্রের ঘর থেকে। তারপর মনে হয়, না এখন থাক। ঘরের ভিতর কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। উঠে বাইরে যান।

টানা বারান্দার এক কোণে একটা চেয়ার নিয়ে বসেছিল হাজিরা কনস্টেবল সুরিন্দর। ভারি বুটের আওয়াজে তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায়, “সাব কুছ চাহিয়ে…?”

“নেহি...”

বারান্দা থেকে থানার উঠোন বেশ খানিকটা নিচু। কয়েকধাপ সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। নুড়ি বিছানো রাস্তা ধরে পনেরো থেকে কুড়ি মিটার এগিয়ে গেলে মেইন গেট। যা সব সময় খোলাই থাকে হাট করে। আপাত উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন সুজয় মাহাতো। বিশ্বামিত্র হত্যা রহস্যের একটা ক্লু খুঁজে বেড়াচ্ছেন খালি। সেই খোঁজ মাথাটাকে কিছুতেই শান্ত হতে দিচ্ছে না। হয়ত বার কয়েক পায়চারি করে আবার ফিরে যেতেন নিজের ঘরে কিন্তু দ্বিগুকে দেখে দাঁড়িয়ে যান। পাঁচিল ঘেরা অনেকটা জায়গা। ফটকগামী পথের দু-পাশে দ্বিগুর আলু, বেগুন আর কড়াইশুঁটির ক্ষেত। নয়নাভিরাম। শীত শেষ হয়ে এলেও বেগুন গাছগুলো এখনও তাজা। উবু হয়ে বসে গাছের গোড়াগুলো খুঁচিয়ে দিচ্ছে দ্বিগু সরেন। ঝাড়খন্ডী ভাষায় তার সাথে দু-চারটে বাক্য বিনিময় হয় সুজয়ের। চাষবাস খুব প্রিয় বিষয় দারোগার । সুযোগ পেলেই নেমে পড়েন নিড়ানি হাতে।

সকাল থেকে মাথার মধ্যে বিশ্বামিত্র আর এস পি-র মুখ দুটো ঘুরছে। এখন সবুজাভ গাছগুলো একটু আরাম দেয় যেন। অন্য দিনের মত সরেনের হাত থেকে নিড়ানিটা নিয়ে যখন লেগে পড়বেন ভাবছেন, তখনই কাক এবং অন্য পাখিদের সম্মিলিত কিচির মিচির কান ঝালাপালা করে দেয়। এটা অনেকক্ষণ ধরেই চলছিল। কিন্তু সহসা যেন মাত্রাছাড়া। থানা চত্বরের পিছন দিকে যাবার জন্য পা বাড়ান। সুরিন্দর বারান্দা থেকে পুরো বিষয়টা খেয়াল করছিল। সে এবং সরেন দুজনেই দারোগার পিছু নেয়।

জিপের বনেটের উপর সেই শালিক পাখিটা যেটা সকালবেলা বৈদ্যুতিক তার থেকে ছিটকে এসে পড়েছিল। বেচারা এখনও বেঁচে আছে। তবে অর্ধমৃত। যমদূতের মত একটা কাক তার দলবল নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। দু-একটা অত্যুৎসাহী এগিয়ে গিয়ে ঠোক্কর লাগাচ্ছে মাঝে মাঝে। আহত পাখির সতীর্থরাও এসেছে। কিন্তু ষণ্ডামার্কা কাকেদের সাথে পেরে ওঠা তাদের পক্ষে মুশকিল।

একটা ভাঙা শুকনো গাছের ডাল পড়েছিল অদূরে। তুলে নিয়ে রে রে করে ওঠেন দারোগা সাহেব। কাকগুলো সটকান দেয়। শালিকটা পড়ে থাকে আগের মতই। কাছে এগিয়ে যান সুজয়। ডান হাত দিয়ে পরম মমতায় তুলে নেন পাখিটাকে। অসহায় আত্মসমর্পণ, ডানা ঝাপটাবার শক্তিটুকুও নেই।

একেই কি তবে বলে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ । দুম করে কেন যেন বিদ্যুৎ এর মত শব্দবন্ধটা উদয় হয়। যা বিশ্বামিত্র সেন বলেছিলেন অনাদি গোসাঁইকে।

আটাশ

যাদবপুর। কলকাতা।

এই রহস্যের সমাধান করতে হলে স্বপ্ননীল এবং রহস্যময়ী অলকানন্দার ভিতরের রসায়ন খানিক খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বৈকি। কথা হচ্ছিল অলকানন্দা এবং স্বপ্ননীলের প্রথম পরিচয়ের দিনগুলো নিয়ে।

ইয়ুনিভার্সিটির যে গেটটা দিয়ে বেরিয়ে রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ের দিকে যাওয়া যায়, সেখানে পান বিড়ি সিগারেট থেকে শুরু করে হরেক পসরা। গেটের উল্টোদিকেই কে-পি-সি হাসপাতালের প্রবেশদ্বার। ফলের পসরা, জামা কাপড় এবং চায়ের দোকান নিয়ে জমজমাট সর্বক্ষণ। সব মিলিয়ে জায়গাটা বেশ ঘিঞ্জি।

একদিন নীলের বাড়ি ফেরার সময়ে অলকাননন্দা দাঁড়িয়েছিল হাসপাতালের গেটে। যথা সময়ে নীলকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলে, সেও হাঁটা দেয় লেবেল ক্রসিংয়ের দিকে। আগে আগে। মিনিট দু'য়েকের মধ্যে যা হবার তাই হয়। প্রায় অলকানন্দার ঘাড়ের উপর এসে পড়ে স্বপ্ননীল, “কী ব্যাপার এইদিকে? আমি তো খেয়ালই করিনি এতক্ষণ...!”

চকিতে ঘোরে অলকানন্দা। ভাবখানা এমন, পিছনে যে নীল এটা জানতই না, “ও তুমি ! আমি একটু এইদিকে যাব...।”

“কোনদিকে ?”

“বিবেকনগর কালী বাড়ীর দিকটায়। আমাদের ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে থাকে...”

“ও আচ্ছা...”

“লেবেলক্রসিং অব্ধি আর কোনও কথা হয় না। ক্রসিং পেরিয়ে রিকশা স্ট্যান্ডের কাছে এলে মুখ খোলে স্বপ্ননীল , “আজ লাইব্রেরিতে যাওনি?”

“না।”

“এতটা সংক্ষিপ্ত উত্তর আশা করেনি নীল। আবার বলে, “কেন ?”

এই কথার পিঠে কিছু না বলে উল্টে আর একটা প্রশ্ন করে অলকানন্দা,

“আচ্ছা মহাপ্রভু কে?”

“মানে !”

প্রশ্নের মাথা মুণ্ডু কিছুই বোঝা যায় না। ফ্যাল ফ্যাল করে হলুদ ডোবানো সন্ধ্যায় তাকিয়ে থাকে ছেলেটা, ক্রমে রহস্যময়ী হয়ে ওঠা এক নারীর দিকে।

“মানে... আমি আসলে বলতে চাইছি..., উনি কে এমন যাঁর জন্য ফার্মাকোলজির একজন স্টুডেন্ট লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে থাকে!”

প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে নীল বলে , “একজন ইতিহাসের ছাত্রীর কাছে এই প্রশ্ন আশা করিনি !”

স্বপ্নর কথা যেন শুনতেই পায়নি এইভাবে বলে নন্দা, “আমার ঠিক জানা নেই সাইন্স ডিপার্টমেন্টের কতজন স্টুডেন্ট, ল্যাব ছেড়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে ঐ সব নিয়ে সময় কাটায় !”

এবার পারদ চড়তে থাকে নীলেরও , “পৃথিবীর অনেক কিছুই তোমার জানা নেই অলকা। সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে। হ্যাঁ ফার্মাকোলজির স্টুডেন্ট... তো.. ! মহাপ্রভুকে নিয়ে পড়াশুনো করা যাবে না !”

প্রতিক্রিয়া দেখে অলকা বুঝতে পারে, বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। গলার স্বর আবার মিহি করার চেষ্টা করে , “ও ডোন্ট বি সিলি। জোকস অ্যা...পার্ট। লিভ ইট ...”

বড় ঝিলটার পাশ দিয়ে হাঁটছিল ওরা তখন। আর একটু এগিয়ে গেলেই রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে বাঁ দিকে। এগিয়ে গেলেই স্বপ্ননীলের কলকাতার ঠিকানা।

মুখে ‘লিভ ইট’ বললেও, দু-এক মুহূর্ত নির্বাক থাকার পর আবার আগের প্রসঙ্গ ফিরিয়ে আনে নন্দা। তবে এবার ভঙ্গিমা খানিক মোলায়েম, “অ্যাকচুয়ালি আমার জানতে ইচ্ছে করছে, চৈতন্য মহাপ্রভুর বিষয়ে কেন তোমার এত আগ্রহ! ওঁর সাথে তোমার সম্পর্কটা ঠিক কী ? লাইব্রেরিতে বইগুলো ওইভাবে গিলতে দেখে, এই প্রশ্নটাই খালি ঘুরে ফিরে মাথায় আসে আমার।”

‘সম্পর্ক’ এর কথাটা খুব কিছু ভেবে বলা হয়নি। কথার লেজুড় হিসাবে মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু স্বপ্ননীল ঘুরে দাঁড়ায় অলকানন্দার দিকে। স্থির চোখে বলে, “ইয়েস...। হ্যাঁ...সম্পর্ক আছে। ডু ইউ নো দ্যাট ...উনি আমার পূর্বপুরুষ। অ্যানসেস্টর।”

‘অ্যানসেস্টর’ শব্দটা বলার সময়, যেন সোনার আভায় কেঁপে ওঠে স্বপ্ননীলের শরীর। বাক্য শেষ হলে সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না । বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় হন হন করে।

অলকানন্দা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। দু’চোখে বিস্ময়।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

জন্ম-৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে লেখালেখির শুরু। এই উপন্যাস ছাড়াও লেখকের প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলি হল— ‘আসলে ভালবাসার গল্প’, ‘রোধবতীর নীল রং’, ‘একে রহস্য দুইয়ে লক্ষ্যভেদ’। দেশ, আনন্দমেলা, কৃত্তিবাস, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, কথা-সাহিত্য, বহুরূপী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা। এছাড়াও বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান ‘সুন্দরম পুরস্কার’ পান ২০১৪ সালে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন