preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ২৪
ধারাবাহিক

চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ২৪

ঝানু ড্রাইভার দ্বিগু সোরেন। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা আঁটুলির মত ঝুলে আছে পুলিশের সাথে। খুনখারাবি ওর কাছে নতুন নয়, তাও ওকে এরকম করতে দেখে অবাক হন সুজয় এবং মহাদেব। খামগুলো নিজের ড্রয়ারে চালান করতে করতে লাফ দিয়ে উঠে পড়েন ওসি, “কোথায় খুন!”
“নিমিয়া মোড়ে। আমি দোকানে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে বাইকে করে এসে গুলি চালালো...!”
বিশ্বামিত্র খুনের এখনও অব্দি কোনও কিনারা করতে পারেনি পুলিশ তারই মধ্যে ঘটে গেল আরও একটা খুন!

পঁয়ষট্টি

চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।

কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল আবদুলের আব্বাজানের। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন, “আমি এখন তবে আসি...অনেক চোখ এড়িয়ে থানায় এসেছি। ফিরতে হবে এবার।”
“হ্যাঁ আসুন। সন্দেহজনক কোনও কিছু জানতে পারলে অবশ্যই খবর দেবেন। আর হ্যাঁ ...সাবধানে যাবেন।”
মানুষটি দরজা অব্দি গিয়ে আবার ফিরে আসেন।
“কিছু বলবেন?”
“হ্যাঁ। আর একজন যে এসেছিল আমার বাড়ির উঠোনে, তার নামটাও মনে পড়েছে এবার।”
“কী?”
“অনন্ত...।” শব্দটা বলে একটু সময় নেন। তারপর আবার বলেন, “অনন্ত মহাষুর।”
এ আবার কেমন নাম!
“আপনি পুরো নামটা কি শুনেছেন?”
সাদা দাড়ির ফাঁকে মৃদু হাসেন বৃদ্ধ, “না পুরোটা একসাথে শুনিনি। কখনো বা ‘অনন্ত’ আবার কখনো বা মহাষুর বলে ডাকা হচ্ছিল। আমি দুটো একসাথে যোগ করে বানিয়ে নিয়েছি...”
“ভিতরে আসব?”
মুখ তুললে স্বপ্ননীলকে দেখা যায়।
“এরই মধ্যে চান খাওয়া হয়ে গেল?”
“না, এই অবেলায় চানটা আর করিনি। তবে খাওয়া হয়ে গেছে। অ্যাকচুয়ালি ব্যাগটা ফেলে গিয়েছিলাম।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন। নিয়ে যান।”
ব্যাগটা নিয়ে আবার যেই বেরোতে যাবে স্বপ্ননীল, দারোগার একটা প্রশ্ন সেঁধিয়ে যায় মগজে।
“আচ্ছা ‘মহাষুর’-রা কোথাকার লোক বলতে পারবেন। আই মিন এই ধরনের ‘সারনেম’ কাদের হয়?”
কথাটা অনুধাবন করতে একটু সময় লাগে। তারপর বলে স্বপ্ননীল, “মোস্ট প্রবাবলি উড়িষ্যা...।”
মি. মাহাতোর কপালের ভাঁজ আরও স্পষ্ট হয়। উড়িষ্যার লোক এইখানে কী করছে! এরাই দাঙ্গার আগুনটা লাগাচ্ছে না তো? বাইরে থেকে অস্ত্রের যোগান কি এরাই দিচ্ছে?

আবদুলের বাবা বিদায় নিয়ে ফিরে যান।
এইদিকে, সকালে শিক্ষামন্ত্রী সশরীরে এসেছিলেন এসপির দপ্তরে। তিনি নতুন কোনও কথা বলেননি। গত দুদিন ধরে যা বলে আসছেন তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। খুনি পাকড়াওয়ের কথা বলতে এসে নেতাসুলভ ধমক চমকও দিয়েছেন এসপি-কে। মিনিট পনেরো ছিলেন, একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছেন হেডকোয়ার্টার। তবে একেবারে শেষমুহূর্তে, যাওয়ার আগে যা বলে গেছেন মন্ত্রীমশাই, তা আলাদা করে উল্লেখযোগ্য, “দেখিয়ে… উয়ো শালা মার্ডারার বাচকে যায়েগা কাহা...! আজ নেহি তো কাল পাকাড়হি লেঙ্গে। বাত ইয়ে হ্যায় কি... মার্ডারার কে সাথ সাথ, উয়ো বিশরামিতজীকা যো রিসার্চ বাগাড়া হ্যায় না, উসকা ভি পুরা ডিটেইল চাহিয়ে হামে...।”
আসলে উচ্চপদস্থ বিশ্বামিত্র, সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাব থেকে নাটকীয় ভাবে ইস্তফা দেওয়ার পর থেকেই, পুরো কর্মকাণ্ডের উপর একটা ‘বার্ডস আই ভিউ’ প্রশাসন রেখেছিল। কোথা থেকে কী দেহাবশেষ পাওয়া গেছে, কার বংশতালিকা নিয়ে বিশ্বামিত্র নাড়াঘাঁটা করছেন, সবই তাদের স্ক্যানারে।
ফোনে আড়ি পাতা থেকে শুরু করে সর্বত্র জারি ছিল অদৃশ্য হানাদারি। কিন্তু দুম করে খুনটা যে হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি।
শিক্ষামন্ত্রী বিদায় নেবার সাথে সাথে দুটো কাজ করেন এসপি। সুজয় মাহাতোকে কোনোরকম ইনফরমেশন না দিয়ে, প্রথমেই, জনা তিনেকের একটা ফোর্স পাঠান বিশ্বামিত্রের বাড়ি। এবং তিনি নিজে রাধামাধবপুর এলাকার সমস্ত ব্যাংকগুলিকে ফোন করে জানার চেষ্টা করতে থাকেন, যে তাদের ভল্টে বিশ্বামিত্র সেনের কোনও ডকুমেন্ট গচ্ছিত আছে কিনা।
যে ব্যাংকে ছিল, তারা জানিয়ে দেয় যে, ভল্টে প্রাপ্ত ‘ডকুমেন্ট’ নিয়ে তাদের লোক ইতিমধ্যেই চন্দ্রপুরা থানায় রওয়ানা দিয়েছে। এতক্ষণে পৌঁছেও গেছে সম্ভবত।
এটা জানার পর কী করেন এসপি সেটাই এখন দেখার।

ছেষট্টি

চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।

আবদুলের আব্বাজান বেরিয়ে যাবার আগেই ওসির ঘরে এসেছিল স্বপ্ননীল। দাঁড়িয়ে ছিল। বসতে বলেন ওসি, “বসুন। আপনাকে আরও একটা কথা জিজ্ঞাসা করার আছে আমার।”

টেবিলে চায়ের খালি কাপ এবং বাটার টোস্টের আধখাওয়া টুকরো। টোস্টে কামড় দিতে দিতে আবার আবৃত্তির ঢঙে বলেন মাহাতো,

একা নই আমি/ আরও আছে দুজন/ যারা বড় দামি / বিশ্বামিত্র–বাল্মীকি—আছে আরও একজন, যারে প্রলয়ঙ্কর মানি...
“মি. বিশ্বামিত্র সেনের পাঠানো এই ম্যাসেজটায় প্রলয়ঙ্করটা কে হতে পারে সেটা একটা আন্দাজ করা গেছে... কিন্তু বাল্মীকিটা কে হতে পার বলে আপনার মনে হয়?”
নীল যখন বাল্মীকির হোয়ার অ্যাবাউটস নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে, তখনই মহাদেব আসেন। বলেন, “স্যার ব্যাংক থেকে একজন লোক এসেছেন।”
“হ্যাঁ। গতকাল আমি আবার ফোন করেছিলাম। বিশ্বামিত্রর ভল্টে যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা ইমেডিয়েট পাঠানোর জন্য। ঠিক আছে... আসতে বলুন।”
ব্যাংকের লোক তিনখানা খাম তুলে দেয় মাহাতোর হাতে। খাম খুলে দেখার আগেই আর এক কাণ্ড ! ছুটতে ছুটতে দ্বিগু আসে,
“স্যার মার্ডার! খুন!”
শব্দগুলো ঘরের মধ্যে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরতে থাকে। হাফাচ্ছে দ্বিগু সরেন। দুই চোখ বিস্ফারিত। সারা শরীরে কাঁপুনি।
ঝানু ড্রাইভার। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা আঁটুলির মত ঝুলে আছে পুলিশের সাথে। খুনখারাবি ওর কাছে নতুন নয়, তাও ওকে এরকম করতে দেখে অবাক হন সুজয় এবং মহাদেব। খামগুলো নিজের ড্রয়ারে চালান করতে করতে লাফ দিয়ে উঠে পড়েন ওসি, “কোথায় খুন!”
“নিমিয়া মোড়ে। আমি দোকানে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে বাইকে করে এসে গুলি চালালো...!”
মহাদেব চিৎকার করে ওঠেন, “কারা! কারা গুলি চালিয়েছে!”
“চিনতে পারিনি। মুখ বাঁধা ছিল রুমালে। একটু আগে যেই মুসলিম ভদ্রলোক এসেছিলেন তাকেই খুন করা হয়েছে...”
বেরিয়ে পড়েন মাহাতো। পিছন পিছন দ্বিগু, মহাদেব মুর্মু, বিজিত কোলে এবং স্বপ্ননীল।
রবিবার। ‘মার্কেট গ্রাউন্ডে’ হাট বসার দিন। অন্য দিন এই রাস্তায় এত লোক থাকে না, কিন্তু হাটবারে যেন মানুষের ঢল নামে। আজও নিশ্চয়ই তাই ছিল। তাহলে ধরে নিতে হবে, প্রায় থিক থিক করা ভিড়ের মধ্যেই, গুলি চালিয়েছে আততায়ী।
বেশ কিছুটা দূর থেকেই দৃশ্যটা দেখতে পান সুজয়। আবদুলের আব্বাজান চিৎ হয়ে পড়ে আছেন রাস্তার মাঝখানে। ইতিমধ্যেই শুনশান হয়ে গেছে চারদিক। ঝাপ বন্ধ হয়ে গেছে আশপাশের দোকানগুলোর।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ। বিকেল ফুরোনোর সময় হালকা শীত জঙ্গলের বাতাসে। তাও ঠাণ্ডাটা খুব একটা মালুম হচ্ছিল না এতক্ষণ। কিন্তু, ডেডবডি সামনে থেকে দেখার পর, সারা শরীরে যেন একটা ঠকঠকানি ঢুকে যায় স্বপ্ননীলের।
সামনের দিক থেকে গুলি করা হয়েছে। এখনও গল গল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। ধুলো আর দূরের খোয়াই টিলার ফাঁক দিয়ে আসা পড়ন্ত সূর্যের আলোয় যা মিশে যাচ্ছে। মাথা আর মুখ বাদ দিয়ে দেহের উপর দিকটা লাল। তবে লুঙ্গিটা এখনও সাদা। সাদা আর লালে ভয়াবহ ‘কনট্রাস্ট’।
হাত দুটো সটান ছড়ানো দেহের দু'পাশে। কোমর থেকে দু’পা ছড়িয়ে ইংরাজি ‘ভি’ এর মত আকৃতি নিয়েছে। চোখ খোলা। ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সদ্য ঘটেছে ঘটনাটা,ফলত চক্ষুদ্বয় এখনও তাজা। যা আরও বীভৎসতা দিয়েছে সমগ্র দৃশ্যপটকে।
দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নীল। ডিউটি অফিসার বিজিত, দ্বিগুকে বলে চকের বাক্সটা নিয়ে আসার জন্য। বডি তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে স্পট মার্কিং করতে হবে। দ্বিগু সরেন চলে গেলে মোবাইল বার করে পটাপট ছবি তুলতে আরম্ভ করে বিজিত।
সুজয় মরদেহের পাশে বসে খুব ভালো করে একবার নিরীক্ষণ করেন। তারপর যথারীতি ফোন করেন হাসপাতালে। বিষয়গুলির মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। সেই বিশ্বামিত্র খুন পরবর্তী গতানুগতিকতা।
এখান থেকে হাসপাতাল পাঁচ মিনিটের পথও নয়। একজন ডাক্তার এবং দুজন কর্মচারি স্পটে পৌঁছে যান দ্রুত। স্বপ্নর চেনা লাগে ওই দুজন স্টাফকে। মনে পড়ে আজ সকালেই দেখেছে ওদের। স্যারের বডি বয়ে নিয়ে এসেছিল মর্গ থেকে।
“না কিছু পাচ্ছি না, নো...নো সাইন অফ লাইফ ...” ভালো করে দেখার পর ডাক্তার প্রকাশ করেন নিজের অভিমত। সুজয় বলেন, “সে আমি বুঝতেই পেরেছি। বাট ফর্মাল প্রসিডিয়োর শুড বি মেইনটেইনড।”
“আমরা কি তবে বডি নিয়ে যাব?”
বিজিত কোলের ছবি তোলা গিয়েছিল। ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বলে, “জাস্ট আ মিনিট। আমাদের একটা ছোটো কাজ বাকি আছে...”
দ্বিগু চক নিয়ে চলে এসেছে। স্পট মার্কিং হয়ে গেলে বৃদ্ধের দেহ চালান হয়ে যায় মর্গে। থানার দিকে পা বাড়ান সুজয়রা। পাশে পাশে হাঁটে নীল। হঠাৎ করে এস আই মহাদেব বলেন, “স্যার আমার মনে হয়, স্বপ্ননীল বাবুর আজ রাতে আর না যাওয়াই ভালো...”
“কেন মি. মুর্মু !”
মহাদেব একটু সময় নিয়ে বলেন, “কেন ঠিক বলতে পারব না, আসলে সরস্বতী বৈগাকে পাঠানো ম্যাসেজের কথাটা দুম করে মনে পড়ে গেল। ওই যে কী একটা ছিল না ঐ ম্যাসেজে... একা নই আমি ...আছে আরও দুজন…”
আর মনে করতে পারেন না মহাদেব। সুজয় বলেন, “হ্যাঁ। বিশ্বামিত্র বাবুর হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা সেটি। আমারও মনে আছে। তা... ঐ কথা এখন মাথায় আসার কারণ!”
সে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় মহাদেবের পক্ষে। হয়ত বৃদ্ধের খুনটাই মাথার মধ্যে আরও একটা অজানা আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। পর পর খুন আর এত রক্ত দেখলে মানুষের অত ‘কার্যকারণ’ ব্যাখ্যার অবস্থা থাকে না।
সুজয় হাঁটতে থাকেন চুপচাপ। খানিক বাদে, থানার গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে এস আইকে প্রশ্ন করেন, “মি. মুর্মু যদি স্বপ্ননীল থেকে যান, তাহলে আপনি থাকতে দেবেন কোথায়?”
বোঝা যায়, রাতের গাড়িতে স্বপ্ননীল যাক, এটা ওসি সাহেবও এখন আর চান না। মহাদেব বলেন, “সেটা খুব একটা অসুবিধা হবে না স্যার। আমার কোয়ার্টারটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে।”
হ্যাঁ ঠিক। তাঁর কোয়ার্টারটা তালাবন্ধই পড়ে আছে এযাবৎ। কাছেই পিঁপড়াডিহিতে পৈত্রিক বাড়ি মহাদেবের। সেখানেই থাকেন। অফিস কোয়ার্টার ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
মাহাতো এবার স্বপ্ননীলকে জিজ্ঞাসা করেন, “কী করবেন স্বপ্ননীল বাবু?”
নীলের মুখে উত্তর তৈরিই ছিল, “আমিই তো আগেই বলেছি, কয়েকটা দিন থেকে যেতে চাই।”
“কয়েকটা দিন থাকবেন কিনা জানি না, তবে আপাতত আজকের রাতটা থাকুন তারপর দেখা যাবে। মহাদেব আপনাকে এখুনি নিয়ে গিয়ে ওঁর ডেরাটা দেখিয়ে দিচ্ছেন।”
কথাটা বলে নিজের ঘরে ঢুকে যান ওসি। নীলকে মহাদেব বলেন, “আপনি দাঁড়ান, আমি চাবিটা নিয়ে আসছি।”
আসলে সব কিছুই আগে থেকে যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। এক আশ্চর্য নিয়তি নীলকে টানছে। না হলে আজ রাতে এখানে থাকার কথা নয় তার। সে কি পারবে সেই নিয়তির থেকে বেরিয়ে আসতে?

কেতাব-ই’র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন blogzine.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

সাতষট্টি

ফুলওয়ারিতোড়। ঝাড়খণ্ড।

অনেকদিন ধরেই রতনের মাথায় বিষয়টা পাকাচ্ছিল, বাপের আসল খুনি হল, সদাশিব মোহান্তি আর তার দলবল। আজ মুখের উপর কথাটা বলতে পেরে বেশ একটা আরাম বোধ হয়।
ওই কথার পর আর দাঁড়াইনি মোহান্তি ঠাকুর। বাপি হাঁসদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওকে নিয়ে সটকান দেয় সদাশিব। শকুন বুঝতে পেরেছিল, এই মুহূর্তে কথা বাড়ালে বিপদ। শালা ওই জালের কাঠি না ঠেসে ধরে তলপেটে!
ওরা চলে গেলে আরও বেশ খানিকক্ষণ রতন পড়ে থাকে ছেঁড়া জালের পিছনে। যখন মনে হয়, ক্ষতস্থান মোটামুটি মেরামত করা গেছে, বেরিয়ে পড়ে মাছ ধরতে। সাইকেলে চেপে। বেরোনোর সময় সরস্বতী শুধোয়,
“কোথায় যাচ্ছিস রে দাদা?”
“যাই একবার নদীতে ঘুরে আসি... যদি কিছু পাওয়া যায়।”
খানিক দূর গিয়ে আবার ফিরে আসে। বোনকে বলে,
“সাবধানে থাকিস। আজ বিকেলে আর ঘর থেকে বেরোনোর দরকার নেই।”
কথাটা বলে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে রতন,
“দরজার আগলটা দিয়ে রাখিস।”
কথাটা বলে দু-চাকায় চেপে অদৃশ্য হয়ে যায় রতন বৈগা। দূরের বাঁকে, দাদার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে হাসে সরস্বতী। মনে মনে দাদাকে অভয় দেয়। কিন্তু গুঁড়ি মেরে নেমে আসা এই অন্ধকার, নিঃসঙ্গ মেঠো পথ, দাওয়ার মাঝে একলা দাঁড়িয়ে থাকা পলাশ গাছ কী আদৌ এই অভয় বাণী শুনতে পায়! ভর ভরন্ত, পোয়াতি একটা যুবতী মেয়ের জন্য সাঁঝের আন্ধারে ওৎ পেতে থাকতেই পারে ভয়ংকর এক বিপদ।
দামোদরের দিকে যেতে হলে থানার সামনে দিয়েই সুবিধা।
মেঠো পথ পেরিয়ে এসে ওই রাস্তাটাই ধরে রতন। কিন্তু হাসপাতালের বাঁকটা নেওয়ার পর, উর্দিপড়া পুলিশ দেখে থমকায়। কয়েকজন দোকানির সাথে নিরাপদ দূরত্বে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরই বুঝতে পারে বিষয়টা। চাচাজান অর্থাৎ আবদুলের বাবাকে কারা যেন খুন হয়েছে। কী সর্বনাশ! কে মারল চাচাকে!
বুক পকেট হাতড়ায় রতন। হ্যাঁ ফোনটা নিয়ে এসেছে।
প্ল্যান্টে কাজটা পাওয়ার পর একটা ছোটো ফোন কিনেছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে টেপে আবদুলের নাম্বারটা।

আটষট্টি

চন্দ্রপুরা থানা । ঝাড়খণ্ড।

থানার গা ঘেঁষে বড় বাবুর কোয়ার্টার। তার পিছনে এস আই সাহেবেরটা।
সুজয় মাহাতোর আস্তানার পাশ দিয়ে গিয়ে রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে ডানদিকে। ওইদিক দিয়ে কয়েক পা হাঁটলেই মহাদেবের কোয়ার্টার। কেউ থাকে না। কাজেই খানিক জীর্ণ দশা। সামান্য কিছু আগাছাও চোখে পড়ে।
এরপর বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা। জঙ্গল হয়ে আছে। ঝোপঝাড়ের ওই পাড়ে নিচু জমি। কিন্তু বোঝা যায়, সেখানে বসতি আছে দু-এক ঘর। টালির চালে লকলকে লাউ ডগা চোখে পড়ছে এখান থেকে।
“ওগুলি ফোর্থ ক্লাস স্টাফদের কোয়ার্টার।”
“ও আচ্ছা।”
“আসুন।”
লোহার গেট সরাতে সরাতে স্বপ্ননীলকে ডাকেন মহাদেব।
নীল ভেবেছিল, কোয়ার্টারের দরজা খোলার সাথে সাথে একটা বোটকা গন্ধ নাকে এসে ঝাপটাবে। কিন্তু না, সেরকম কিছু পাওয়া যায় না। দুটো বেডরুম-কিচেন-বাথরুম। একটা বেডরুমের সব জানলাগুলো খুলে দেন এস আই। ঝপ করে এক ঝলক বাতাস ঢুকে আসে ঘরে। বাইরে প্রাক সন্ধ্যার আলো, নদী আর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা শহরতলিতে।
না, ধুলোর আস্তরণ নেই মেঝেতে। দেওয়ালও ঝুলহীন। সিলিং থেকে ঝুলে আছে নতুন পাখা। শুধু তাই নয়, মাঝামাঝি একটা খাটও আছে বিছানাপত্তর সমেত। ময়লা হতে পারে বলে বিছানাটা গোটানো।
“আপনি কি মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকেন নাকি?”
“না থাকা হয় না। তবে মাসে একবার পরিষ্কার করাই। আশা করি আপনার অসুবিধা হবে না। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থানায় হয়ে যাবে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। আমার খাওয়া নিয়ে অযথা চিন্তা করবেন না। দরকার হলে নিমিয়া মোড় থেকে রুটি সবজি বা অন্য কিছু...”
এইবারই আসল কথাটা বলেন মহাদেব। প্রথমে দু-দিকে সজোরে মাথা নাড়েন তারপর কেটে কেটে শব্দ বার করেন মুখ থেকে, “উ হু হু... না...ভুলেও ওই কাজটি করবেন না। এলাকার হাল হকিকত কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আপনার সিকুরিটির কথা ভেবে রাতের গাড়িতে যাওয়া বন্ধ করা হল। আর আপনি বলছেন একা একা বার হবেন! একদম না। আর তা ছাড়া...”
“তা ছাড়া?”
“সদ্য মার্ডার হয়ে গেছে নিমিয়া মোড়ে। রাতে রুটির দোকান আজ খোলা থাকবে না।”
মহাদেবের ফোন বেজে ওঠে। সুজয় মাহাতো। ঘরের চাবি নীলকে দিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। যাওয়ার আগে আবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন, “কোনও দরকার হলে আমাদের ইনফর্ম করবেন। নিজে কোথাও যাবেন না। খেয়াল থাকে যেন...।”
নীল এসে দাঁড়ায় খোলা জানালায়। বাইরে তাকিয়ে মনটা ভরে যায়। যদিও, একঘণ্টা হয়নি একটা মৃত্যু দেখে ফিরেছে সে, তাও বলা যায় এই প্রথম ভালো লাগা এখানে আসার পর। দুগ্ধা পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে। প্রায় পুরোটাই। পাথুরে শরীরে শাল গাছের আবরণ আপাদমস্তক। গাছের মাথায় মাথায় ‘টোয়াইলাইট’। পাহাড়ের মাথায় একটা ছোট্টো মন্দির যার চুড়ার ত্রিশূলে পতাকাটা চোখে পড়ছে এতদূর থেকেও। হাওয়ার উড়ছে পতপত করে। পতাকা দণ্ড ঘিরে পাক খাচ্ছে একঝাঁক পায়রা। তাদের ধূসর ডানা ছুঁয়ে ক্রমেই নিরুদ্দেশ ভিনদেশী আলো।
‘বকের পাখায় আলোক লুকায় ছাড়িয়া পুবের মাঠ…’। জানালা থেকে পাহাড়, পাহাড় ছাড়িয়ে আকাশ, আকাশ ছাড়িয়ে অন্তহীন শূন্যতা। হঠাৎ করে নিজেকে খুব ছোটো মনে হয় স্বপ্নর। কোনও কিছুর সীমাহীনতা তাকে ‘ঈশ্বর’ রূপ দান করে। এই প্রকৃতিই তো প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর। অবাক করা এক প্রশ্নের উদয় হয় মস্তিষ্কে। চৈতন্য মহাপ্রভু পুরীতে ছুটে গিয়েছিলেন কি এই প্রকৃতিকে ভালোবেসেই? জগন্নাথ মন্দিরের পাশেই তো আকাশ ছোঁয়া জলরাশি। অন্তহীন। না হলে, কৃষ্ণভজনার জন্য আলাদা করে সেখানে ছুটে যাওয়া কেন!
“দাদা চা...”
দরজায় দ্বিগু সরেন।
চটকা ভেঙে যায় নীলের। বাইরে আলো থাকলেও ঘরের ভিতরে অন্ধকার নেমছে।
“আলো জ্বালাননি...। ডেডবডিটা দেখার পর নিশ্চয়ই মন খারাপ। আমার তো এখনও হাত-পা কাঁপছে মশাই। পুলিশের গাড়ি চালাচ্ছি অনেকদিন। কিন্তু চোখের সামনে এইভাবে খুন হতে দেখি নি কখনও...”
কথাটা বলতে বলতে, সুইচ বোর্ডের দিকে এগিয়ে যায় সরেন। কিন্তু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, “না, পারব না। আমার দুটো হাতই বন্ধ। আপনিই জ্বালিয়ে নিন।”
আগের বার যখন এসেছিল এখানকার মানুষের সাথে এতটা মেশার সুযোগ পায়নি। এইবার ওকে যেটা সবথেকে বেশি অবাক করছে, তা হল এখানকার ভাষা। যারা আদিবাসী, তাঁরা বাংলা বলতে পারেন এবং শুধু তাই নয় অনেকের ভাষা শুনে বোঝার উপায়ই নেই যে, তাঁরা বাঙালি নন। এটার কারণ সম্ভবত, ডিভিসি-চন্দ্রপুরা ইউনিটের বেশিরভাগ স্টাফই বাঙালি, আর সেই ডিভিসি-কে নিয়েই গড়ে উঠেছে ছোটো ছোটো জনপদ।
স্বপ্ননীল আলো জ্বালায়। এলইডি। ঘরের কোণায় একটা ছোট্টো টেবিল, যা এতক্ষণ ঠাহর করা যায়নি। টেবিলে চায়ের কাপ রেখে কেটলি থেকে ঢালে দ্বিগু। পকেট থেকে একটা ঠোঙা বার করে বিস্কুট সাজিয়ে দেয় প্লেটে।
“বিস্কুট লাগবে না।”
“খান খান। সেই রাতের আগে আর কিছু খাওয়া হবে না।”
কেটলি ঝুলিয়ে এগিয়ে যায় সরেন। কিন্তু দরজা অব্দি যাওয়ার পরই ফিরে আসে, “আর হ্যাঁ... আর একটা কথা স্বপ্ননীলবাবু... ভুলেও কিন্তু ঘরের বাইরে যাবেন না। সারা চাঁদপুরা জুড়ে যা ঘটে চলেছে তা আমরাও ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি নতুন মানুষ, কখন কী বিপদ ঘটে যায় কিছুই বলা যায় না।”
কথাটা বলে মিলিয়ে যায় দ্বিগু। হঠাৎ করে আরও একটা খুন যেন সবার শিড়দাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দিয়েছে।
নীল ধীরে ধীরে এসে বিছানা পেতে নেয় খাটে। চা খাওয়া হলে এলিয়ে দেয় শরীরটা। চোখ জুড়িয়ে আসতে চায় ঘুমে। একটানা ধকল চলছে গতকাল থেকে।


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

জন্ম-৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে লেখালেখির শুরু। এই উপন্যাস ছাড়াও লেখকের প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলি হল— ‘আসলে ভালবাসার গল্প’, ‘রোধবতীর নীল রং’, ‘একে রহস্য দুইয়ে লক্ষ্যভেদ’। দেশ, আনন্দমেলা, কৃত্তিবাস, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, কথা-সাহিত্য, বহুরূপী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা। এছাড়াও বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান ‘সুন্দরম পুরস্কার’ পান ২০১৪ সালে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন