preloader
বাংলা বইয়ের e-ভুবন
Menu Categories Search Cart 0
Menu
Cart

Total 0 Items

☹ Your cart is empty

Sub Total:

$0

₹0

বিভাগ
চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ৩
ধারাবাহিক

চৈতন্যে বধিবে কে!: পর্ব ৩

প্রাথমিক কথাবার্তা শেষ হলে উঠে পড়েন সুজয় এবং মহাদেব। বিদায় নেন অনাদির কাছ থেকে। দারোগা গাড়িতে আসতে আসতেই ভাবেন, এখনও অব্দি তিনখানা এইরকম নাম পাওয়া গেল, যাদের সঙ্গে খুন হয়ে যাওয়া বিশ্বামিত্রের একটা যোগসূত্র ছিল। এই তিনজনকে জেরা করে কিছু পাওয়া গেলেও যেতে পারে। এক-আবদুল, দুই-স্বপ্ননীল এবং তিন সরস্বতী বৈগা।

সাত

চন্দ্রপুরা থানা। ঝাড়খণ্ড।

থানায় ফিরেই ব্যাঙ্কের লোককে ডেকে পাঠান মি. মাহাতো। একটা লিস্ট ধরান। বিশ্বামিত্রের অ্যাকাউন্ট এবং লকারের ডিটেইস চাই।

জলের বোতলটা থেকে ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা জল গলায় ঢেলে দেন। এতখানি শুকিয়েছিল ভিতরটা বুঝতে পারেননি। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে নতুন করে ডাইরিটায় চোখ বোলাতে যাবেন, এমন সময় হাজিরা কনস্টেবল সুরিন্দর এসে হাজির হয়, “স্যার মন্দিরের সিকিউরিটি বলবন্ত সিং...”

বিশ্বামিত্রের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুজয় মন্দিরে ফোন করেছিলেন। ডেকে পাঠিয়েছেন বলবন্তকে। আরও একবার কথা বলে নিতে চান তাঁর সাথে,

“হ্যাঁ... আসতে বলুন।”

বলবন্ত ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই, প্রশ্ন পিং পং বলের মত ড্রপ খায়,

“ঠিক কত টাকায় রফা হয়েছিল?”

দারোগার ভাব বুঝতে পারেন না বলবন্ত, “আজ্ঞে স্যার বিসওয়াস করুন আমি কিছু জানি না।”

“বলছি... মন্দির কমিটিকে না জানিয়ে মেইন গেটটা খুলে রাখতেন এমনি এমনি...?”

“আমি ওঁর থেকে কোনও টাকা পয়সা নিইনি।”

“তবে? গোপনে গোপনে কারবার কেন? গেট যে খোলা থাকত আর কাউকে বলেননি তো! বলরাম কিস্কু তো কিছুই জানত না দেখলাম।”

“স্যার বিশরামিতজী আমাকে নিজের ভাইয়ের মত ভালবাসতেন। তাই আমি কথা ফেলতে পারিনি। আর তাছাড়া আমাকে গোসাঁইজিও বলেছিলেন। গোসাঁইজির সাথে রীতিমত দোস্তি ছিল বিশরামিত বাবুর...”

“কী বলেছিলান গোসাঁইজি?”

“উনি বলেছিলেন— সেন বাবু তো রোজ শুভাই আসেন। প্রতিদিন তোর গিয়ে ফটক খোলার দরকার নেই। রাতের বেলা এমনি আবছিয়ে রেখে দিস। আর ফটক যে খোলা আছে, সে কথা উনি ছাড়া আর তো কেউ জানছে না!”

একটু থেমে আবার বলে বলবন্ত, “বিশরামিত বাবু শুধু আমাকে নয়, সবাইকেই ভালবাসতেন। সবার সাথেই বেশ দোস্তি ছিল ওঁর। আমাকে আর আবদুলকে একদিন নেমতন্ন করে খাইয়েও ছিলেন।”

“কে আবদুল!”

“মন্দিরের মালি। ফুলওড়ারিতোড়ের সনাতন-গাজি বটতলা থেকে আসে।”

চন্দ্রপুরা এক শিল্পনগরী। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনকে কেন্দ্র করে যার বেড়ে ওঠা। এর ঠিক পাশেই হল ফুলওড়ারিতোড়। জল-জঙ্গল আর পাহাড় দিয়ে ঘেরা। বিশ্বাস-অবিশ্বাস বুকে নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, বৈগা পাড়া, গাজি বটতলা, মেথর পাড়া ইত্যাদি।

বলবন্তের মুখে আবদুলের নামটা শুনে কী যেন একটু ভাবেন বড়বাবু। তারপর মুর্মুকে ডেকে পাঠান। সকাল থেকে, বাড়ি যাওয়া হয়নি মহাদেব মুর্মুর। ভাবছিলেন বাইকটা নিয়ে একবার পিঁপড়াডিহি ঘুরে আসবেন। ভার্বাল পারমিশন নিতে স্যারের কাছেই যাচ্ছিলেন। ঘরে পা দেবার আগেই ফের তলব।

“ডাকছিলেন?”

“হ্যাঁ। আবদুল বলে ছেলেটার হোয়ার অ্যাবাউট একটু নোট করে নিতে হবে।”

একটা নোট বুক নেন মহাদেব। বলবন্ত বলেন, “আজ্ঞে ফোন নাম্বারটা আমার ফোনে আছে, কিন্তু ঠিকানাটা আমি ফুলওড়ারিতোড়... মানে শুধু এইটুকুই জানি...”

ওসি বলেন, “ঠিক আছে। আপনি ওকে ফোন করে থানায় আসতে বলুন।”

সিং জি ফতুয়ার পকেট থেকে ফোন বার করে আবদুলকে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু খুব সংক্ষিপ্ত হয় সেই পর্ব। কারণ ওই প্রান্তে মোবাইল বন্ধ।

“স্যার সুইচ অফ।”

ওসি সাহেব কী যেন ভাবেন মনে মনে। তারপর বলেন, “ঠিক আছে। দেখছি। আচ্ছা বলবন্ত... আর কাউকে আপনি চেনেন যার সাথে বিশ্বামিত্র বাবুর কথাবার্তা হত।”

“জি সাব ভাবসাব তো অনেকের সাথেই ছিল। কিন্তু অনাদিবাবু ছাড়া আর কারও সাথে মনের কথা খুলে বলতেন বলে মনে হয় না। আমাদের মত আনপড় লোককে পেয়ার করতেন ঠিকই, কিন্তু দিল কি বাত কেন বাতলাতে যাবেন...!”

কথা শেষ হবার আগেই কনস্টেবল সুরিন্দর তিনলাফে এসে হাজির হয় আবার, “স্যার এসপি সাহেব...।”

হাঁপাচ্ছেন সুরিন্দর। বাক্য শেষ হয় না। ইশারায় বলবন্তকে চলে যেতে বলেন ওসি। সুরিন্দর আরও কিছু বলার আগেই বারান্দায় জুতোর আওয়াজ পাওয়া যায়।

এসপি-বোকারো। ব্লু জিনস, হোয়াইট শার্ট, ক্লিন শেভড, ছিপ ছিপে চেহারা। উঠে দাঁড়ান সুজয়, “হোয়াই ডিডিন্ট য়ু কল মি স্যার…?”

“ইটজ ওকে...”

শব্দ দুটো বলতে বলতে মাহাতোর মুখোমুখি চেয়ারটা একহাতে টেনে নিয়ে বসে পড়েন এসপি, “অ্যাকচুয়ালি আই হ্যাভ কেম সেক্টর ফোর পোলিশ স্টেশন। সো...”

একটু সময় নিয়ে আবার বলেন, “হেয়ার্ড... অ্যাবাউট দি ইন্সিডেন্ট...”

“হ্যাঁ আমি আপনাকে ফোন করতাম…”

“হোয়েন? কখন...কখন আমাকে ফোন করতেন আপনি? ইজিন্ট ইট টু লেট!”

ভাঙা বাংলা এবং ইংরাজিতে শুরু করেছেন এসপি। গুটিয়ে যান সুজয়। বোঝার চেষ্টা করেন, খবরটা এত দ্রুত উপর মহল অব্দি গেল কী করে? অবশ্য এই থানা থেকে কেউ খবর না দিলেই বা কী ! এই সব খবর ছড়াতে কী আর বেশি সময় লাগে? এইদিকে, সুপারিটেন্ট ওফ পোলিশের চাপা চোয়াল থেকে বেরিয়ে আসে বাক্য, “মার্ডারটা অ্যাকচুয়ালি কখন হয়েছে? হোয়েন দি ইনসিডেন্ট অকার্ড...”

“সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে।”

“পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট কখন পাওয়া যাবে?”

“অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল আমি দিতে বলেছি।”

“হুমম...”

শেষ শব্দটা বলতে বলতে চেয়ারে ঠেসান দেন ঊর্ধ্বতন। সুজয় মাহাতো বলেন, “হ্যাভ আ কাপ অফ টি স্যার?”

“নো থ্যাঙ্কস। আচ্ছা খুনটা কে করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?”

এসপি সাহেবের ব্যক্তিত্বের কাছে এই প্রশ্ন নেহাতই বালখিল্য সুলভ।

“স্যার ওঁর কোনও এনিমিকে এখনও পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়নি। ইটজ টু ডিফিকাল্ট টু অ্যাজুউম...”

“স্পেশাল কেয়ার ইজ নিডেড ইন দিজ কেস...”

সুজয় বুঝে যান শুকনো জ্ঞান দিতে এসেছেন উনি, “ইয়েস স্যার আই উইল...”

মাহাতোর কথা শেষ করার আগেই এসপি-র একটা ফোন আসে। রুলিং পার্টির শিক্ষামন্ত্রী। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন এসপি। পায়চারি করেন আর কথা বলেন। ঘরের ভিতরে এই মুহূর্তে অন্য কোনও শব্দ নেই। ফোন স্পিকারে দেওয়া না থাকলেও এসপি-র এবং ঐ দিকের কথোপকথন শুনতে পান মাহাতো।

“কিসনে মারা?”

“পাতা চল যায়েগা স্যার...”

“অভিতক কুছ মিলা কে নেহি?”

“মিল যায়েগা স্যার...”

“কা মিল যায়েগা ভাইই...”

“স্যার যিসনে মারা বিশরামিতজি কো...”

“আ বে ও তো মিলনাই চাহিয়ে। ম্যায় নে পুছা কোয়ি ক্লু আবতক মিলা কে নেহি?”

“মিল যায়েগা স্যার...”

“ওয়াক্ত যাদা নেহি লাগনা চাহিয়ে। কেস থোরা আর্জেন্ট হ্যায়...”

“ইয়েস স্যার...হ্যালো স্যার...হ্যালো হ্যালো...”

কেটে গেছে ফোন। এসপি চেয়ারে এসে বসতে বসতে সুজয়কে বলেন, “ক্যায়সা লাগা?”

“কী স্যার?”

শিক্ষা মন্ত্রকের আঁচ লেগে আছে ঊর্ধ্বতনের শরীরে। সেই উত্তাপ তাঁকে বাংলা বা ইংরাজিতে ফিরতে দেয় না। হিন্দিতেই বলে যান সুপারিটেনডেণ্ট, “মেরে অর মেরে বাপ কা বিচ, যো কমুনিকেশন হুয়া, ও আপকো ক্যায়সা লাগা?”

কী বলা যায় বুঝতে পারেন না সুজয়। চুপ করে থাকেন। যাই হোক, এটা স্পষ্ট যে বিশ্বামিত্রর জন্য খোদ মিনিস্ট্রি লেভেল অব্দি নড়ে চড়ে বসেছে।

আবার আগের ভঙ্গিমায় বসেন এস পি। নিজেকে সামলে নিয়ে ক্লিন শেভড মুখ থেকে ফের মাপা শব্দ, সো...মিস্টার মাহাতো...আই অ্যাম ফেসিং দি মিউজিক...

“ইয়েস স্যার...”

“আই থিঙ্ক... নাও ইয়ু শুড আন্ডারস্ট্যান্ড দি আর্জেন্সি অফ দিজ কেস।”

এসপি-র ভঙ্গিমায় মাথাটা বেশ গরম হয়ে যায় মাহাতোর। ফলস্বরূপ একটা ব্যাঁকা কথা বলে ফেলেন, “ইয়েস আই ক্যান... অ্যান্ড আই হোপ, দেয়ার শুড বি অ্যাডিকোয়েট কো-অপারেশনস।”

“মিনস...”

ওসির কথার পরিপ্রেক্ষিতে একটা মাত্র শব্দ এসপি-র। সেই শব্দ ঘরময় পাক খায়। দারোগা সাহেব বলেন, “এই যেমন ধরুন, ডি-টাইপ ব্রিজের দাঙ্গার জন্য এখনও অব্দি কাউকে অ্যারেস্ট করা যায়নি... তাই বলছিলাম… অ্যাডিকোয়েট কো-অপারেশনশ শুড বি নিডেড।”

খোঁচাটা এসপি কতটা গায়ে মাখেন ঠিক বোঝা যায় না। তবে উপর থেকে নিস্তরঙ্গই লাগে। যাওয়ার আগে বলে যান, যদি দরকার হয় তবে দু'একদিনের মধ্যে চন্দ্রপুরা থানায় এক্সট্রা ফোর্স পাঠাবেন।

কেতাব-ই'র ব্লগজিন বিভাগে লেখা পাঠাতে চান? মেল করুন manuscript.ketabe@gmail.com-এ। মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখুন ‘কেতাব-ই ব্লগজিনের জন্য লেখা’

আট

চন্দ্রপুরা। ঝাড়খণ্ড।

পুলিশ এখন ছাই দেখলে ওড়াবে, না দেখলেও ওড়াবে। আহুজা বিদায় নিলে ফের দুগ্ধার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন মাহাতো, এস আইকে সাথে নিয়ে।

মিনিট দশেকের মধ্যে পাকদণ্ডি পথ বেয়ে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ায় দুগ্ধা পাহাড়ের রাধামাধব মন্দিরের সামনে।

অনাদি গোসাঁই ফিরেই দুঃসংবাদটা পেয়েছিলেন মন্দির কমিটির সেক্রেটারি বলরাম কিস্কুর থেকে। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে বসেছিলেন অশ্বত্থ গাছের নীচে, বাঁধানো বেদির উপর। পুলিশের গাড়ি দেখে এগিয়ে আসেন, “আপনারা এসেছেন খুব ভালো হয়েছে। না হলে আমি নিজেই থানায় যেতাম...”

সুজয় এবং মহাদেব অনাদিকে অনুসরণ করে এসে বসেন গাছতলায়। সুজয় বলেন,“ইন্টারেস্টিং... কেন! আপনি থানায় যেতেন কেন?”

“সত্যি কথা বলতে কী বিশ্বামিত্রবাবুর মৃত্যুটা আমার কাছে মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। আমার কিছুদিন ধরেই মনে হচ্ছিল এই রকম কিছু একটা ঘটতে পারে। আমি ইদানীং ভোররাতে, একা একা মন্দিরে আসতে ওঁকে বারণও করেছিলাম।”

বিস্ময় সুজয় এবং মহাদেবের চোখে। সুজয়রাও বসে পড়েন বেদির উপর, “আপনার এরকম মনে হওয়ার কারণ!”

“গতবছর, যেদিন ডি-টাইপ ব্রিজের কাছে ঝামেলাটা হল, তার পরদিন এসেছিলেন মন্দিরে।”

“তারপর?”

“স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে উত্তেজিত দেখেছিলাম মানুষটাকে।”

এরপর, বিশ্বামিত্র সেন এবং নিজের কথোপকথনের যে বর্ণনা দেন অনাদি, তা লিপিবদ্ধ করলে যা দাঁড়ায় তা অনেকটা এইরকম,

—এ কী এত উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?

—সামনে অনেক বড় বিপদ গোসাঁইজি। ব্রিজে কাল কী হয়েছে জানেন না!

—হ্যাঁ জানি।

—প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমি তো ঠিক করেছি, মরতে হলে মরব, কিন্তু তার আগে অব্দি নিজের কাজ করে যাব। সাধ্যমত...

—বিশ্বামিত্রবাবু হঠাৎ করে আপনার মৃত্যুর কথা উঠছে কেন!

—আমি ইতিহাসকে দিচ্ছি বিজ্ঞানের আশ্রয়। ফলে ইতিহাস ক্রমেই হচ্ছে অনস্বীকার্য। যে সত্যের পিছনে আমি ছুটছি তা জনসমক্ষে এলে ইতিহাসটাকে আবার নতুন করে লিখতে হবে। শেষ হয়ে যাবে ধর্মের মুখোশ পরা শয়তানদের বড় বড় বুকনি।

—আপনি কাদের কথা বলছেন?

—কেন! যারা মন্দির ভাঙে, মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়...

—আপনার কথা আমি সবটা বুঝতে না পারলেও, এটা বুঝতে পারছি যে কোথাও একটা বিপদের সম্ভাবনা আছে। তা...আপনি সেই কথা পুলিশকে জানাচ্ছেন না কেন?

—পুলিশ কিছু করতে পারবে না। আমার শত্রু যারা, পুলিশ তাদের হাতের খেলনা। ক্রীড়নক মাত্র। ঠুঁটো জগন্নাথ। ...আচ্ছা ভগবান জগন্নাথকে কবে থেকে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বলা হয় আপনি জানেন গোসাঁইজি? যিনি সর্বশক্তিমান তিনিই ভগবান। আর তাই যদি হবে, তাহলে ভগবানের কাছে কোনও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাই তো আসলে কোনও বাঁধা নয়।

—হ্যাঁ, ঠিক। তাহলে?

—সেটাই তো কথা। তা সত্ত্বেও ভগবানের নামের আগে ‘ঠুঁটো’ শব্দটা যোগ করা হল। তাহলে আমরা কী ধরে নেব, মহাশক্তিমান ঈশ্বরের সামনে এমন কোনও অন্যায় ঘটে গিয়েছিল যা তিনি স্বয়ং ঈশ্বর হয়েও রোধ করতে পারেননি?

“আরও বোধহয় কিছু একটা বলেছিলেন বিশ্বামিত্র বাবু, কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। কারণ, তখন পাহাড়ের মাথায় হাওয়ার বেগ খুব বেড়েছিল। শুকনো পাতার মড়ামড়ানি আর পাখির ডাকে সেই কথা আমার কর্ণগোচর হয়নি।”

অনাদি গোসাঁই, তাঁর এবং সদ্য খুন হয়ে যাওয়া মিস্টার সেনের কথোপকথনের বর্ণনা শেষ করেন। সুজয় বুঝতে পারেন রহস্য বেশ ভালই ঘোঁট পাকাচ্ছে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আবার শুনতে পান অনাদি গোসাঁইয়ের গলা। না, শেষ হয়নি, কথোপকথনের শেষ অংশটুকু এখনও বাকি। যা নিম্নরূপ—

—বিশ্বামিত্রবাবু, আমি জানি না আপনি কী কাজ করছেন? কিন্তু এটা বুঝতে পারছি, যা করছেন তা অসাধু ব্যক্তির বিপক্ষে। সেই কারণেই আবার বলছি, আপনার উচিত পুলিশকে বিষয়টা জানানো এবং নিরাপত্তা দাবি করা।

—আসলে আমি আমার কাজ শেষ করে ফেলেছি। জনসমক্ষে নিয়ে আসাই শুধু বাকি। সেটা আমার কিছু হয়ে গেলেও এখন আর আটকে থাকবে না। বাদবাকিটুকু ‘স্বপ্ননীল’ই করতে পারবে।

“কে স্বপ্ননীল!”

জানতে চান সুজয়। অনাদি বলেন, “সেটা আমিও সঠিক জানি না। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম স্বপ্ননীল যেই হোক না কেন বিশ্বামিত্রবাবুর গোপন কাজের সাথে অনেকটাই জড়িয়ে।”

শেষ কথাগুলো বলে দু-এক মুহূর্তের জন্য শব্দহীন হন ঋষিতুল্য অনাদি গোসাঁই। দারোগা সুজয় মাহাতো বলেন, “গোসাঁইজি আমাদের ভয় ছিল আপনাকে নিয়ে। বিশ্বামিত্র সেন যে খুন হয়ে যাবেন সেটা ভাবিনি।”

দারোগা সাহেবের কথায় মৃদু হাসেন ‘চন্দ্রপুরার চৈতন্য’। মুখে স্মিত হাসিটি বজায় রেখেই উত্তর করেন, “আমার কিছু হবে না দারোগা সাহেব।”

একটু থেমে আবার বলেন, “আপনি বোধহয় একটা কথা জানেন না।”

“কী?”

“বিশ্বামিত্র সেন শুধু যে নিজের বাড়িতে বসে গোপনে কিছু একটা করছিলেন তাই নয়, হনুমান মন্দিরের দাঙ্গার পর তিনি আমার নগরকীর্তনের দলেও ভিড়ে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই চলে যাচ্ছিলেন আমার সাথে বৈগাপাড়ায়। আমরা একাধিক দিন পরমেশ্বর বৈগার বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছি। নামগান করতে করতে রাত হয়ে গেলে সেই বাড়িতে রাত্রিবাসও করেছি।”

এই কথায় একটু অবাক হয়ে যান দারোগা সাহেব, “বৈগাপাড়ার পরমেশ্বর বৈগা? যে হনুমান জয়ন্তীর দিন মার্ডার হয়ে গেছে। তাঁর বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ!”

“পরমেশ্বর নেই কিন্তু তাতে কী? তাঁর ছেলে রতন এবং মেয়ে সরস্বতী, এই দু’জন তো আছে। বৈগাপাড়ার পুরোহিত সদাশিব মোহান্তিকে সবাই ভয় পায়। একমাত্র রতন আর সরস্বতী ছাড়া। ওরা সদাশিবের রক্ত চক্ষুকে আমল না দিয়ে, যে দিন আমাদের প্রথম আশ্রয় দিল সেদিন থেকেই...”

“সেদিন থেকেই!”

“বাপ-মা মরা ছেলে মেয়েগুলোর উপর বেশ মায়া পড়ে গিয়েছিল বিশ্বামিত্র সেনের। অকৃতদার বিশ্বামিত্র, সরস্বতীকে নিজের মেয়ের মত দেখতেও আরম্ভ করেছিলেন একসময়। আসলে স্নেহ সততই নিম্নগামী এবং তা পারস্পরিক আশ্রয় খুঁজে বেড়ায়।”

প্রাথমিক কথাবার্তা শেষ হলে উঠে পড়েন সুজয় এবং মহাদেব। বিদায় নেন অনাদির কাছ থেকে। দারোগা গাড়িতে আসতে আসতেই ভাবেন, এখনও অব্দি তিনখানা এইরকম নাম পাওয়া গেল, যাদের সাথে বিশ্বামিত্রের একটা যোগসূত্র ছিল। এই তিনজনকে জেরা করে কিছু পাওয়া গেলেও যেতে পারে। এক-আবদুল, দুই-স্বপ্ননীল এবং তিন সরস্বতী বৈগা।

নয়

হোটেল পদ্মনাভ ও সেদিনের সেই চূড়ঙ্গগড় দুর্গ। দুই চৈতন্য-কথা। আদি ও অনাদি।

দারোগার ধারণা যে ভুল নয় তা ধীরে ধীরে অবশ্যই প্রমাণিত হবে। বিশ্বামিত্র হত্যা রহস্য মূলত পাক খাবে এই তিনজনকে ঘিরেই। তবে এই তিনজন ছাড়াও যারা আছে, তাদের কথাও ভুলে গেলে হবে না। কাজেই আবার একটা ‘বার্ডস আই ভিউ’; পুরীর সেই হোটেলে, যেখানে চলছে বি. এইচ. এম. ডি-র কোর গ্রুপের মিটিং।

হোটেল পদ্মনাভর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল উমানাথ সিন্ধিয়ার গাড়ি। লোকচক্ষুকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য অনেকটা পথ ঘুরে এসেছে বিএমডবলু-এক্স ওয়ান। আসার পথে একজনকে তুলে নিয়েছেন সিন্ধিয়া।

পুরীর বিখ্যাত হোটেলগুলির মধ্যে পদ্মনাভর নাম উপর দিকে থাকবে। কনফারেন্স রুমই আছে কম করে গোটা পাঁচেক। সুইমিং পুল, বার, হেলিপ্যাড… কী নেই! গাড়ি নিয়ে ইচ্ছে করলে রুফ টপ অব্দি চলে যাওয়া যায়। অবশ্য এই সব না থাকলে উমানাথ সিন্ধিয়ার মত মানুষ এইখানে চিন্তন বৈঠকের ডাক দেবেনই বা কেন? তবে উনি নিজে ডেকেছেন, এই কথা বললে পুরোপুরি ঠিক বলা হয় না। যা করেছেন হাইকম্যান্ডের নির্দেশে। আর, ‘হাইকম্যান্ড’ ব্যাপারটা এতটাই শক্তিশালী যে সিন্ধিয়ার কাছেও ধোঁয়াশা। অটোক্রাটিক ওয়ানওয়ে কমুনিকেশন। কোনও ডিটেলিংয়ের সুযোগ নেই।

সে যাই হোক, একটি মূল বিষয় তার কাছে স্ফটিক জলের মতই স্বচ্ছ যে, তাদের সবার লড়াই হিন্দুত্বের জন্য। বেদ-উপনিষদের বিস্মৃত হওয়া গৌরবকে পুনরুদ্ধারের জন্য। এই বিশ্বাসটুকুই যথেষ্ট নিজেকে জাগিয়ে রাখার ক্ষেত্রে। কাজেই, ‘হাইকম্যান্ড’-এর খুঁটিনাটি না জানলে খুব কিছু ইতর বিশেষ হওয়ার নেই। কাজ করে যাওয়াটাই মূল কথা।

কুড়ি জনের কনফারেন্স রুমটা বুক করা হলেও আজ বৈঠকে মানুষ মাত্র চারজন। উমানাথ সিন্ধিয়া, অরবিন্দ প্রতিহারী, অনন্ত মহাষুর এবং অলকানন্দা ঠাকুর।

উমানাথের কথা আমরা আগেই জেনেছি, যেটুকু জানার দরকার। এবার বাকি তিনজনের কথা, অতি সংক্ষেপে।

অরবিন্দ প্রতিহারী দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যই শুধু নন, লোকাল মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানও বটে। স্থানীয় রাজনীতিতে শেষ কথা বলেন।

অনন্ত মহাষুর দলের সিকিউরিটি ম্যানেজার। অসুরের মত চেহারা। মার্শাল আর্ট এবং যে কোনও অস্ত্র চালনায় সিদ্ধহস্ত। স্থির এবং গভীর দৃষ্টি। চোখ দেখলে শুধু বাচ্চা নয়, বড়দের হৃদয়ের গতিও বাড়তে পারে।

চতুর্থজন হলেন অলকানন্দা ঠাকুর। জন্ম জামেশেদপুর। পড়াশুনো মূলত কলকাতায়। হিস্ট্রিতে মাস্টার্স। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে। কলেজে থাকাকালীন আলাপ উমানাথ সিন্ধিয়ার সাথে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। তার রাজনীতিতে আসার পিছনে সিন্ধিয়ার প্রভাব অনস্বীকার্য। বর্তমানে অলকানন্দা বি. এইচ. এম. ডি-র ইস্টার্ন রিজিওনের গুরুত্বপূর্ণ পদে। এবং এর সাথেই বর্তমানে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় চাকুরীরত সে। যাদবপুর এইট বি বাস স্ট্যান্ডের কাছে, একটি দু-কামরায় ফ্ল্যাট তার ঠিকানা।

অলকার শরীর থেকে আলো ঠিকরোয় না, তথাপি আবেদন অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। চোখে কখনও হালকা লাইনার, কখনো বা ল্যাকমি কাজল। চাউনি সব সময় অতলস্পর্শী। যে কোনো পোশাকেই স্বচ্ছন্দ। কিছুটা কার্লি হেয়ার অধুনা স্ট্রেইটেন। কখনো হর্সটেইল, কখনো বা ছাড়া। বিএমডাব্লিউ-এক্স ওয়ান, অলকানন্দাকেই তুলে নিয়ে এসেছে আসার সময়।

পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে ঝাড়খণ্ডে, হিন্দুত্বের জয়ধ্বজা ঊর্ধ্বপানে তুলে ধরতে গিয়ে যাঁদের বাঁধার মুখে পড়তে হচ্ছিল, বা এখনও হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে দু’জন উল্লেখযোগ্য মানুষ হলেন, বিশ্বামিত্র সেন এবং ‘চন্দ্রপুরার চৈতন্য’। একজনকে ইতিমধ্যে খতম করা গেলেও চন্দ্রপুরার মহাপ্রভুটিকে এখনও কিছু করা হয়নি।

আজকের ‘চিন্তন’ প্রকৃত মহাপ্রভুর ‘রেফারেন্স’ নিয়ে আর চন্দ্রপুরার মহাপ্রভুকে নিয়ে। ‘রেফারেন্স’-এর বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিষ্কার হবে ধীরে ধীরে। মোদ্দাকথা প্রকৃত চৈতন্যর ভূত এবং ‘চন্দ্রপুরার চৈতন্য’র কার্যকলাপ, দুই, বি. এইচ. এম. ডি-র কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার পক্ষে বিপজ্জনক।

চৈতন্য মহাপ্রভু এক ভীষণ বাঁধা হইয়া দাঁড়াইয়াছেন সেনাপতি গোবিন্দ বিদ্যাধর ভৈ এবং ওড়িশার রাজসিংহাসনের মাঝে। সেই বাঁধা কীরূপে অতিক্রম করিতে পারা যায়, তাহা লইয়া সবিশেষ আলোচনা হেতু একটি সভার আয়োজন করিয়াছেন বিদ্যাধর।

সেই সভা হেতু চূড়ঙ্গগড় দুর্গের ভূগর্ভস্থ গোপন কক্ষে, মুখোমুখি তিনখানা আসনে উপবেশন করিয়াছেন গোবিন্দ বিদ্যাধর, মহাকাল প্রতিহারী এবং পঞ্চসখার অন্যতম শ্রীযুক্ত জগন্নাথদাস।

প্রাথমিক কথন শেষ হইলে গোবিন্দ খানিক সময় লইয়া কহিলেন, “ইহা আমাদের কাছে এক্ষণে স্ফটিকের মত স্বচ্ছ যে আমাদের উদ্দেশ্য মূলত অভিন্ন। কী সেই উদ্দেশ্য? না, রাজা প্রতাপরুদ্র এবং ঐ গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীর সমূল উৎপাটন। আগে আমাদের সন্ন্যাসীকে এই পৃথিবী হইতে সরাইতে হইবে এবং তাহার পর ধ্বংস করিতে হইবে রাজা প্রতাপরুদ্রকে। চৈতন্য থাকিতে রাজার দেহে আঁচড় অব্দি লাগিবে কিনা সন্দেহ। সুতরাং…”


কেতাব-ই’র মুদ্রিত বই, ই-বই এবং ব্লগজিন বিভাগের লেখালিখির নিয়মিত খোঁজখবর পেতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন


এই ব্লগজিনে প্রকাশিত সমস্ত লেখার বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।

মন্তব্য করুন

লেখক

জন্ম-৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতা। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখার মাধ্যমে লেখালেখির শুরু। এই উপন্যাস ছাড়াও লেখকের প্রকাশিত অন্য উপন্যাসগুলি হল— ‘আসলে ভালবাসার গল্প’, ‘রোধবতীর নীল রং’, ‘একে রহস্য দুইয়ে লক্ষ্যভেদ’। দেশ, আনন্দমেলা, কৃত্তিবাস, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, কথা-সাহিত্য, বহুরূপী এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু লেখা। এছাড়াও বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান ‘সুন্দরম পুরস্কার’ পান ২০১৪ সালে।

অন্যান্য লেখা

দেখতে পারেন